নদী দখল-দূষণ : উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করুন

আমরা বলি নদীমাতৃক বাংলাদেশ। আমাদের দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা প্রধানত নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছে। শিল্পায়ন, নগরায়ণ, ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি সব নদীতীরে, নদী ঘিরেই বিকাশ লাভ করেছে। অথচ লোভ, মুনাফা আর স্বার্থের কারণে দেশের নদীগুলি দখলে দূষণে বিপর্যস্ত, মৃতপ্রায়, অনেক নদী দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। নদীদস্যুতার কবলে পড়ে নদীমাতৃক সভ্যতা সংস্কৃতি শীর্ণা বিশীর্ণা। নদী দখলদারদের সংখ্যা বেড়েছে। নদীর সীমানাও অনেক ক্ষেত্রে মুছে গেছে অবৈধ স্থাপনার কারণে।
গত মঙ্গলবার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বার্ষিক রিপোর্ট ২০১৯ প্রকাশকালে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, দেশের ৭৭৬টি নদীর ৬৩ হাজারের বেশি নদী দখলকারী চিহ্নিত করা গেছে। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিলো ৫৭৩৯০ অর্থাৎ প্রায় ৬ হাজারের মতো দখলদার বেড়েছে। গত বছর ২৯ শতাংশ দখলদারকে উচ্ছেদ করা গেছে। সরকারের উচ্ছেদ অভিযান সত্ত্বেও দখলদারের সংখ্যা বেড়েছে এটি খুবই হতাশাজনক। এনআরসিসি চেয়ারম্যান বলেন, যে সব নদী মরে গেছে, সেগুলি চিহ্নিত করে দখলদারদের কবল হতে উদ্ধার করা প্রয়োজন। দেশে অনেক পরিবেশ বিষয়ক আইন আছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের বাস্তবায়ন এবং দখল ও দূষণকারীদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত দেন। একটি জাতীয় পত্রিকায় তথ্য সম্বলিত এই প্রতিবেদন এসেছে গত বুধবার।
রিপোর্টটি প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনায় বক্তারা নদীদখল ও দূষণকারীদের হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে সাজা প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশগ্রহণ করে পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান সরকার দেশের নদীগুলি রক্ষা করতে সংকল্পবদ্ধ উল্লেখ করে বলেন, সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের নানা সংস্থা নদী দখলের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালন করেছে যা প্রশংসনীয় তবে সেগুলি হয়েছে প্রধানত রাজধানীর আশেপাশের নদীগুলির দখল দূষণ নিয়ে। দেশের অন্যান্য শহরেও কয়েকটি নদীর অবৈধ দখল নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে সেসব তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আবার উচ্ছেদ অভিযানের কিছুদিন পর পুনরায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের বিষয় গণমাধ্যমে এসেছে। নদীর সীমানা চিহ্নিত করে তা রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা হয়েছে। কিছু উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালিত হয়েছে কিন্তু এই প্রক্রিয়া এখন স্থগিত রয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ খ্যাত নদীটিকে অবৈধ দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। নদী সুরক্ষায় আইন আছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অঙ্গীকারও রয়েছে। তা সত্ত্বেও যদি নদী রক্ষায় যথোচিত ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তবে তা দুঃখজনক। প্রভাবশালী মহল যেভাবে দেশের সর্বত্র নদীর দখল ও স্থাপনা নির্মাণ করে নদীগুলিকে মৃতপ্রায় এবং দেশের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে সক্রিয় ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হলে এর ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। সংস্থাটির সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে অধিকতর মনোযোগী এবং দায়িত্ববান হতে হবে।
সরকারের ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা’ সফল করতে হলে নদীগুলি দখল ও দূষণ থেকে মুক্ত করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং প্রবাহ সচল রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন প্রয়োজন তবে তা অবশ্যই নদী এবং পরিবেশের সুরক্ষা করেই করতে হবে। নদী আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি জীবনÑজীবিকার অন্যতম প্রধান উপাদান, নদী বাঁচলে আমাদের সভ্যতা বাঁচবে। উন্নয়নও দীর্ঘস্থায়ী হবে।