ধ্বংসের পথে পারকি সমুদ্রসৈকত

মামলা জটিলতায় ক্রিস্টাল গোল্ড জাহাজ

জাহাজ কাটতে অনুমতি লাগবে হাইকোর্টের

সুমন শাহ্, আনোয়ারা :
চট্টগ্রাম শহর থেকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারা উপজেলার বারশত ও রায়পুর ইউনিয়নের অংশ নিয়ে পারকি সমুদ্রসৈকত। পারকির সাগর চর ও জেগে ওঠা বিশাল ঝাউ বাগান ‘ক্রিস্টাল গোল্ড’ নামে আটকে পড়া জাহাজের কারণে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হচ্ছে। জাহাজটি আটকে থাকায় সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে পলি মাটি জমে গেছে। সাগরের জোয়ারের পানির ধাক্কায় ঝাউগাছের গোড়া থেকে সরে যাচ্ছে বালু। ফলে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সৈকত।
সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৩০ মে দুপুরে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে ‘ক্রিস্টাল গোল্ড’ জাহাজটি পারকি সমুদ্রসৈকত চরে আটকা পড়ে। প্রবল বাতাসের তোড়ে দিক হারিয়ে ও ইঞ্জিন বিকল পড়লে জাহাজটি চরে আটকে যায়। এটি চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টি নেতা মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের বলে জানা যায়। তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও জাহাজটি পারকির চর থেকে সরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। আটকে পড়া এ জাহাজের কারণে পলি মাটি জমে নষ্ট হচ্ছে পুরো সৈকত চর এলাকা।
২০১৯ সালে (৬ জানুয়ারি রোববার) পারকি সমুদ্রসৈকতে অনুমতি ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ কাটায় অভিযোগের শুনানি শেষে ‘ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল। শুনানিতে ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজের মালিক আবুল কালাম আজাদ হাজির হন। শুনানিতে এক হাজার ৪৯১ শতাংশ সৈকতের ওপর জীববৈচিত্র্য নষ্ট এবং সামুদ্রিক জীব ধ্বংস করার অপরাধে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ জমা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। এ মামলার কারণে এখনো পর্যন্ত জাহাজটি আটকে আছে সৈকত চরে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, পারকি সৈকত চরে জাহাজ কাটা ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করার অপরাধে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয় ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। জাহাজ কাটার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে আমরা ৩২টি শর্ত দিয়ে কাটার নির্দেশ দিই। ঠিকাদার এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হাইকোর্টের নির্দেশের পাশাপাশি জরিমানা পরিশোধসহ শর্ত মেনে জাহাজ কাটতে পারবে। তিনি আরো বলেন, জরিমানা ২ কোটি টাকা বিষয়ে তারা হাইকোর্টে আপিল করেছে। হাইকোর্ট এখনো পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। জাহাজ কাটতে চাইলে হাইকোর্ট থেকে অনুমতি নিতে হবে বা জরিমানা মওকুফ করে আনতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজের স্বত্ব¡াধিকারী কর্ণফুলী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর আমাদেরকে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিলো। এ নিয়ে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করেছি। আদালত যে নির্দেশনা দেবে সেটা মেনেই কাজ করব।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শীতের শুরুতেই যেখানে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকার কথা কিন্তু নেই কোনো পর্যটক। নেই পর্যটকের ভিড় আর সৈকতের দোকানি ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের আনাগোনাও। আর এসবের জন্য স্থানীয়রা দায়ী করছেন বিষফোঁড়া হিসেবে পরিচিত ‘ক্রিস্টাল গোল্ডকে’। এটির কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত পারকি দিনে দিনে বিলুপ্তের পথে। এমনটায় মনে করছেন সৈকতে আসা পর্যটক, ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা।
রোববার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে পারকি সমুদ্রসৈকত ঘুরে দেখা যায়, পর্যটকদের পদচারণা কম, শীতের শুরুতে যেখানে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকত সেখানে পর্যটক এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে সৈকতকে ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দাভাব বিরাজ করছে। অনেকে এখন এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছে। সৈকতে ঘোড়া, মোটরবাইক ও ছবি তোলার কাজে নিয়োজিতরা বসে থাকেন পর্যটকের আশায়। ঘোড়া নিয়ে পর্যটকের আশায় দাঁড়িয়ে থাকা নয়ন বলেন, ঘোড়া নিয়ে সৈকতে আসলে আগে ৪ থেকে ৬ শত টাকা আয় হতো। এখন পর্যটক নেই, বিকালে বা শুক্র-শনিবারে কিছুটা হলেও চরে পলিমাটির কারণে মানুষ ঘোড়ায় উঠতে চায় না।
ক্যামরাম্যান মিজানুর রহমান বলেন, এখানে কার্ডধারী ক্যামরাম্যান আছি আমরা ৩০ জন। মাঝেমধ্যে কিছু পর্যটক আসে, তবে সৈকত চরের অবস্থার জন্য কোথাও দাঁড়িয়ে ছবি তোলা যায় না। একসময়ে পর্যটকরা ১শত থেকে ২শত ছবি তুলে নিতো, এখন তো ২০-৩০টা ছবির বেশি তোলা হয় না ।
স্থানীয় বারশত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমএ কাইয়ুম শাহ বলেন, জাহাজটির কারণে সৈকতের অবর্ণনীয় ক্ষতিসাধন হচ্ছে। পলি জমে নষ্ট হচ্ছে সৈকতের পরিবেশ। জাহাজটি যথাযথ নিয়ম মেনে দ্রুত সৈকত থেকে সরিয়ে নেয়া উচিত। না হলে ধীরে-ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এ সৈকত।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, সৈকত চরে জাহাজ কাটার কোনো নিয়ম নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর জাহাজ কাটার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৩২টি শর্ত দিয়েছে। এ নিয়ে তাদের জরিমানাও করা হয়েছে। বর্তমানে আদালতে মামলাটি চলমান রয়েছে। তিনি আরো বলেন, জাহাজটির কারণে পারকি সৈকতের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমরা জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি চিঠিও দিয়েছি জাহাজটি সরানোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। এটি সরানো খুবই প্রয়োজন, না হলে ধীরে-ধীরে হারিয়ে যাবে পারকি সৈকতের সৌন্দর্য।