দুর্যোগমুক্ত সুন্দর পৃথিবীর প্রত্যাশায়

সাধন সরকার »

২০২০ সাল পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহের বিপুল বাসিন্দাদের মোটেও ভালো যায়নি। কায়মনোবাক্যে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন প্রার্থনা করেছে করোনামুক্ত সুন্দর সুপ্রভাতের জন্য। জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে মহামারি করোনা হানা দিয়েছে তার মতো করে। পুরো পৃথিবী করোনার বিরুদ্ধে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সাল হোক দুর্যোগমুক্ত- এই প্রত্যাশা সবার।
নতুন বছর মানে নতুন হিসাব-নিকাশ, নতুন সম্ভাবনা। এককথায়- নতুন বছর, নতুন শপথ, নতুন প্রত্যাশা, নতুন পথচলা। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। করোনা-কালে জীবনযাত্রা সাময়িক থমকে গেলেও অগ্রযাত্রা থামেনি। জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার, পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য বুহৎ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক উন্নতি, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষ সমতা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের সমতা, স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাত, গড় আয়ু বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশে^র দরবারে আজ প্রশংসিত। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ উন্নয়ন কাজ জনসাধারণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। তবে করোনা-কালে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসেছে। এখন শিক্ষার গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া বেশি জরুরি।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। দেশের প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের সামনে এখন দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উন্নয়নের কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদীয়মান বাংলাদেশ আজ পাশর্^বর্তী পাকিস্তান ও ভারতের থেকে এগিয়ে! এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও সাফল্য অর্জনে জোর দিতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে।
মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিলে চলবে না। দেশের অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। এই দুর্নীতি নির্মূলে জিরো টরালেন্স নীতি বাস্তবে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। মিডিয়া ও সংবাদপত্র যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। যতই প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ধনী-গরিবের আয় বৈষম্য ততই বাড়ছে! এক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, সব ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। একটা গোষ্ঠী সবসময় মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বাজার থেকে ফায়দা লুটের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। এদের কারণে জনসাধারণকে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই কালোবাজারি ও মজুদদারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। মাদক ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলমান রাখতে হবে। তরুণ জনগোষ্ঠীকে সব ধরনের মাদক থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা সব সময়ের জন্য জরুরি। শ্রমের ন্যায্যমূল্য যাতে নিশ্চিত হয় সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়া। তাই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় গুরুত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে সমাধানে জোর দিতে হবে। শুধু ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করলে সমস্যার সমাধান হবে না, তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়াই হবে মূল সমাধান।
দুঃখের কথা, পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশে^ প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ভুগছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তাই ‘প্যারিস চুক্তি’ মেনে উন্নত দেশের সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় চলমান সব প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাও জরুরি। শহরগুলোতে সব ধরনের দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, বর্জ্য দূষণ, পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণ রোধে আধুনিক ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া বাঁচার পথ নেই। দেশের নদ-নদীর দখল ও দূষণ রোধ এবং রাজধানী ঢাকার পরিবেশ রক্ষার দিকে বেশি নজর দিতে হবে। দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ রক্ষা হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের ওপর ঝুঁকিও কমবে। এ ছাড়া প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষাসহ পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা গেলে গড় আয়ু আরও বাড়বে এবং উন্নয়ন টেকসই হবে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে সহিংসতা, হানাহানি খুব একটা দেখা যায়নি। জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের কার্যক্রম ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তাই বলা যায়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত স্থিতিশীল হবে দেশের উন্নয়ন তত ত্বরান্বিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সর্বস্তরে গণতন্ত্র ও কল্যাণকর রাজনীতি কাম্য। রাজনীতিবিদদের নীতির প্রশ্নে আপোসহীন থাকতে হবে। দেশের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও পরস্পরের ওপর কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ জরুরি। রাজনীতির ক্ষেত্রে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শন ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। প্রায় সবসময় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে! এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল ও জোটকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সবাই যেন গণতান্ত্রিক শর্তগুলো অবাধে উপভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে প্রবেশ করতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। উন্নয়ন অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে।
তথ্য মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। বাস্তবিক পক্ষে বেকারের সংখ্যা আরও বেশি! কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হলে উন্নয়ন টেকসই হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে! করোনা-কালে বেকার তরুণের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
তরুণদের জীবনে এত বড় কর্মসংস্থানের সংকট এর আগে আসেনি। তরুণদের কর্মসংস্থানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সব বাধা দূর করার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার পথ সুগম করতে হবে। করোনা মহামারির কারণে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ইতিমধ্যে সেশনজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তরুণ সমাজ দীর্ঘ সময় ধরে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। তাই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে হবে। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের আবেদন ‘ফি’ উঠিয়ে দিতে হবে। তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যেককে তাদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারলে দেশটা বদলে যেতে বেশি সময় লাগবে না। নতুন বছরে করোনাবিহীন সুখী-সমৃদ্ধ ২০২১ বাংলাদেশের প্রত্যাশা সবার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স