দুই বছরের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান

বৃহত্তর চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। বিশেষ করে কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, বে টার্মিনাল, মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের মতো মেগাপ্রকল্পসমূহের কাজ সম্পন্ন হলে এর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে চট্টগ্রাম মহানগর। এই প্রকল্পসমূহ সমাপ্ত হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম মহানগরকে করতে হবে যুগোপযোগী। বিশ্বমানের নগর করা না গেলে এসকল মেগা উদ্যোগের সুফল পুরো মাত্রায় মিলবে না। নগর রূপান্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়নযজ্ঞের মূল কাজটি করবে মূলত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আগামীর চট্টগ্রাম বিনির্মাণে সিডিএর পরিকল্পনা ও চলমান বড় প্রকল্পগুলো নিয়ে সুপ্রভাতের সহ সম্পাদক কাঁকন দেব এর সাথে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ

সুপ্রভাত : বিশ্বমানের নগর হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে সিডিএর পরিকল্পনা কী ?

জহিরুল আলম দোভাষ : বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন চট্টগ্রামের উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল। চট্টগ্রাম এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে গ্লোবাল সিটির মর্যাদা লাভ করেছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-ভাবনার দিকনির্দেশনা অনুসারে চট্টগ্রামকে বিশ্বমানের নগর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে। আমাদের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। এসব কাজ সম্পন্ন হলে নগরে আমূল পরিবর্তন আসবে।

সুপ্রভাত : মাস্টারপ্ল্যান একটি শহরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম নগরীর বর্তমান মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ  ২০১৫  সালে শেষ হওয়ার পর এখনো নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন হয়নি। কখন এর কার্যক্রম শুরু হবে?

দোভাষ : মাস্টার প্ল্যানের মেয়াদ ২০১৫ সালে শেষ হলেও সিডিএ অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিশদ পরিকল্পনা ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান) প্রণয়ন করে। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা সংক্রান্ত  কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করেছে। বর্তমানে পরামর্শক নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। আমরা আশা করছি আগামী ২ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামবাসী পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান পেতে যাচ্ছে।

সুপ্রভাত : সিডিএ’র মাধ্যমে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যুগে প্রবেশ করছে চট্টগ্রাম। এই বড় প্রকল্পের অগ্রগতি কতটা।  এছাড়া আগামীতে কি এই এক্সপ্রেসওয়ে নগরীর বিভিন্ন দিকে সম্প্রসারণের সুযোগ রাখা হচ্ছে?

দোভাষ :  চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে মূল শহরে প্রবেশের লক্ষ্যে তিন হাজার ২শ ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ চলমান আছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়বে। বন্দরের কার্যক্রম গতিশীল হবে। শহরের ভয়াবহ যানজট নিরসন ছাড়াও শহর এলাকা ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে উন্নত যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত হবে। এ প্রকল্পে লালখান বাজার হতে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার  দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভারের মধ্যে বর্তমানে সি-বিচ থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার অংশে নির্মাণকাজ চলছে। বন্দরের নিরাপত্তার স্বার্থে রিভাইস অ্যালাইনমেন্ট প্রণয়ন করা হয়েছে। সল্টগোলা ক্রসিং থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত রিভাইস অ্যালাইমেন্ট অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন হবে। এছাড়া আরও যেসব জটিলতা ছিল, তা কাটিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করার অনুমতি পাওয়া গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বহদ্দারহাট থেকে বিমানবন্দরে অতি অল্প সময়ে যাতায়াত করা যাবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে সিইপিজেড ও কেইপিজেডে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মিরসরাই ইকোনমিক জোন ও আনোয়ারা শিল্প এলাকায় যাতায়াত সহজতর হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নগরের বিভিন্ন দিকে যাতে সম্প্রসারণ করা যা, সে ব্যবস্থাও রাখা হবে।

সুপ্রভাত : কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মিত হচ্ছে। এতে আনোয়ারা, পটিয়া ও বাঁশখালী অংশে ব্যাপক উন্নয়ন হবে। ড্যাপে এসব এলাকায় গ্রোথ সেন্টার নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন টানেল ছিল না, মাতারবাড়ি বন্দর ছিল না। এখন এই এলাকা নিয়ে সিডিএ’র পরিকল্পনা কী?

দোভাষ : বিগত মাস্টারপ্ল্যানে নগরের তলদেশে টানেল নির্মাণের কথা সরাসরি বলা না থাকলেও কর্ণফুলীর  নদীর  উভয় তীরকে ব্রিজ ও অনুরূপ যেকোনো উপায়ে চট্টগ্রামের সুষমও উন্নয়নের প্রস্তাবনা ছিল। সে প্রস্তাবনার আলোকে নদীর অপর প্রান্তে আনোয়ারা, পটিয়া, বাঁশখালী গ্রোথ সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাবনা ছিলো। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের  কাজ চলছে। এটি সম্পন্ন হলে নদীর অপর পারে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে,  তা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এসব অঞ্চলের ভূমি ব্যবহার ও  আর্থ সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করছে। নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সময় টানেল নির্মাণের বিষয়টি কেন্দ্র করে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ প্রদান করেছে। এছাড়া মাতারবাড়িতে বন্দর নির্মিত হলে তা চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে কীভাবে সমন্বয় সাধন করে কাজ করবে সে বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা হবে।

সুপ্রভাত : জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে মহানগরীর পরিধি। এক্ষত্রে শহরতলীর সীতাকুণ্ড ও হাটহাজারীর পরিকল্পিত উন্নয়নে সিডিএ’র পরিকল্পনা কী?

দোভাষ : ভৌগোলিকভাবে চট্টগ্রাম শহরের বিকাশের প্রবণতা উত্তরমুখী। সীতাকু- ও হাটহাজারী অভিমুখি, এসব এলাকার উন্নয়নের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নের অবকাঠামো এসব এলাকায় বিস্তৃত করার একটি সম্ভাবনা তৈরি করা গেলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম বির্নিমাণে বড় ধরনের অর্জন হিসেবে গণ্য করা হতে পারে।  মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সময় এ সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হবে।

সুপ্রভাত : একটি নগরের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শহরতলী ও শহরের অনতিদূরের এলাকাগুলোর সাথে দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে রেলপথ ও সড়কপথে এসব এলাকার দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে সিডিএ’র পরিকল্পনা কী?

দোভাষ : একটি আদর্শ শহর প্রতিষ্ঠা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই শহরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন যোগাযোগ অবকাঠামোর ওপর। সে দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু রেল ও সড়ক যোগাযোগ নয়,  চট্টগ্রামের শহরের মধ্যে প্রবাহিত বিভিন্ন খালকে পুনরুজীবিত করে রেল, সড়ক এবং খাল এ তিন ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা উন্নয়নের স্বার্থে  খুবই জরুরি।  তবে এ সকল অবকাঠামো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধীনে ন্যস্ত থাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সম্বনিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। সেটার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

সুপ্রভাত : নগরীর যানজট নিরসনে আউটার রিং রোড খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। কবে নাগাদ শেষ হবে?

দোভাষ : আউটার রিং রোডের ৯৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে এটা যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কিছু কাজ বাকি আছে, ইপিজেডের সাথে একটা সংযোগ করা হবে। এটি একনেকে অনুমোদনের জন্য গেছে, সেটা পাশ হলে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা হবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।

সুপ্রভাত : একই অবস্থা ডিটি-বায়েজিদ সংযোগ সড়কের ক্ষেত্রেও। নির্ধারিত সময়েও শেষ হয়নি কাজ। এটি পুরোপুরি সচল হবে কবে?

দোভাষ : ডিটি-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এটার কাজ শুরু করেছে।  প্রথমে এর দুই লেন ছিলো, পরবর্তীতে চার লেনের কাজ শুরু হয়েছে।  আগে  দুই লেনে রেলট্র্যাকের ওপর ওভারব্রিজ ছিলো। যেহেতু চারলেন করা হচ্ছে, তাই নতুন দুই লেনের ওপর ওভারব্রিজ করা হচ্ছে। চারলেনের কাজ করায় সময় লাগছে,  এ বছরের জুনের মধ্যে সড়কটি চলাচলের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে আশা করছি।

সুপ্রভাত : সিডিএ নর্থসাউথ-ওয়ান নামে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প কবে নাগাদ শুরু হবে?

দোভাষ : নর্থসাউথ-ওয়ান চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। এটি ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে একনেকে পাঠানো হয়েছে। একনেকে অনুমোদন হলে এ রাস্তার কাজ শুরু হবে।

সুপ্রভাত : বাকলিয়া এক্সেস রোড সিডিএ’র আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। কিন্তু  দশ তলা ভবন নিয়ে বছরের পর বছর সময় পার করেছে সিডিএ। এখন সড়কের নকশায় পরিবর্তন এনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রকল্প সম্পর্কে যদি বলেন…

দোভাষ : এটিও গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক। সিরাজউদ্দোলা রোড থেকে শাহ আমানত সেতুর  সংযোগ সড়ক।  বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সংযোগ হবে। এর কাজ ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। মাঝখানে একটি দশতলা বিল্ডিংয়ের কারণে সমস্যা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলাম। কমিটি সুপারিশে নকশা একটু পরিবর্তন করার কথা বলেছে। সেই তদন্ত রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেলে আমরা কাজ শুরু করবো।

সুপ্রভাত : কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে চাক্তাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত বাঁধ কাম রোড বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এই রোডের সাথে নগরীর সংযোগের জন্য ফিডার রোড নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি-না?

দোভাষ : কর্ণফুলী শাহ আমানত ব্রিজ থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। এ সড়ক নির্মাণ হলে শহরের নি¤œাঞ্চলের জোয়ারের পানি উঠবে না। সেখানে সুইস্লগেট নির্মাণ করা হবে। জোয়ারের সময় বন্ধ রাখা হবে। ভাটার সময় খুলে দেওয়া হবে। তাহলে নিচু এলাকা চাকতাই, মোহরা, কালুরঘাট, বাকলিয়া ও খাতুনগঞ্জে জোয়ারের পানি ঢুকবে না। এটার সাথে কয়েকটা সংযোগ সড়ক করার প্রস্তাবনা আছে। এ রাস্তা হয়ে গেলে আমরা সংযোগ সড়ক ও ফিডার রোড করব। কয়েকটি ফিডার রোডের প্রস্তাবনা রয়েছে। বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত ব্রিজের যে সড়ক রয়েছে, সে অনুযায়ী  কালামিয়া বাজার থেকে আরেকটি রাস্তা করার প্রস্তাবনা আছে।  বাকলিয়ায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি ট্রেনিং সেন্টার করছে। সেটার সাথে একটি সংযোগ সড়ক করার প্রস্তাবনা রয়েছে।

সুপ্রভাত: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

দোভাষ : সুপ্রভাতকেও ধন্যবাদ।