দাহকার্যে জলদুর্ভোগ!

অভয়মিত্র মহাশ্মশান প্রতি বর্ষা মৌসুমে ও জোয়ারের পানিতে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবে থাকে- সুপ্রভাত

অভয়মিত্র মহাশ্মশান বছরের পর বছর উন্নয়ন বঞ্চিত #
পরিচালনা পরিষদের পদত্যাগ দাবি#

রুমন ভট্টাচার্য :
অবহেলা ও অযত্নে পড়ে আছে দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডের অধীন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচালিত বলুয়ার দীঘি পাড়ের অভয়মিত্র মহাশ্মশান। বছরের পর বছর কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি। যেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সৎকার করা হয়। মহাশ্মশানটি প্রায় ১৭-১৮ বছর ধরে প্রতি বর্ষা মৌসুমে ও জোয়ারের পানিতে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবছে। ফলে অন্তিম যাত্রায়ও জলদুর্ভোগের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের। এছাড়া খাল ও নালার ময়লা-আবর্জনা ঢুকে নষ্ট হচ্ছে শ্মশানের পবিত্রতা।
গত ১৯ আগস্ট হাঁটু পানিতে সৎকারের একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। যা নাড়া দেয় সনাতন ধর্মালম্বীদের। সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অনেকেই বর্তমান শ্মশান পরিচালনা পরিষদ ব্যর্থ উল্লেখ করে পদত্যাগ দাবি করেছেন।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, শ্মশানের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় কাদাপানি জমে আছে।
ভুক্তভোগী দেবব্রত পাল দেবু বলেন, ‘গত ১৯ আগস্ট আমার বোনকে দাহ করতে আসি সকাল ১১টায়। হঠাৎ বেলা ১২টায় চারদিক থেকে পানি আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে হাঁটু সমান পানি জমে যায়। এই হাঁটু সমান পানির মধ্যেই চরম দুর্ভোগ নিয়ে দাহকাজ শেষ করতে হয়েছে। এছাড়া খালের ময়লা পানিতে আসা বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা ভাসতে দেখা যায়। যা শ্মশানের পবিত্রতা নষ্ট করছে।’
মহাশ্মশানে কাজ করা ডোম লিটন দাস বলেন, ‘এইরকম পরিবেশে দীর্ঘ ১৭-১৮ বছর ধরে কাজ করছি।’
জানা গেছে, প্রায় ১০ বছর ধরে মহাশ্মশান পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদে আছেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী ও সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন প্রকৌশলী ও সাবেক কাউন্সিলর বিজয় কুমার চৌধুরী কৃষান।
এলাকাবাসীর প্রশ্ন মহাশ্মশান উন্নয়নে এত বছর ধরে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কি করলো?
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অভয়মিত্র মহাশ্মশান পরিচালনা পরিষদের সভাপতি জহরলাল হাজারী উত্তেজিত হয়ে উঠেন। বলেন, পানি উঠছে কি হয়েছে? এই দু’দিন সারা চট্টগ্রামে পানি উঠছে। এখানে ১০ বছর ধরে পানি উঠছে। এটা বন্ধ করার কোনো সাজেশন থাকলে বলেন। চাক্তাই খালের উন্নয়ন না হলে এ পানি কখনো বন্ধ করা যাবে না। তবে আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে যাতে আমরা সুন্দরভাবে লাশটা দাহ করতে পারি সেজন্য লাকড়ির শ্মশানটা উঁচু করব। নিচু জায়গাগুলো ভরাট করে সলিন দিয়ে দেব। দুটা চুলার জায়গায় চারটা চুলা বসানোর পরিকল্পনা আছে। এসব বাস্তবায়নে করপোরেশনের সহযোগিতা প্রয়োজন।’ তবে কবে কাজ শুরু করা যাবে এ নিয়ে তিনি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেননি এবং দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সাথে পরিষদের কোনো বিরোধ নেই বলে জানান।
স্থানীয়রা জানান, মহাশ্মশান পরিচালনা পরিষদ শ্মশান উন্নয়নের চেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন মন্দিরের বার্ষিক উৎসব নিয়ে। ফলে শ্মশানের উন্নয়নে কারো কোনোরকম মাথাব্যথা নেই। এ কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।

পুরো শশ্মানজুড়ে পানি আর পানি- সুপ্রভাত

এলাকার বাসিন্দা জিতেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রতিবছর ‘বড় বড় নেতা’ আসেন উৎসবে। বড় বড় আশা দিয়ে যান। কিন্তু দিন, মাস, বছর যায় প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন আর হয় না। ফান্ডের কোনো হিসাব নেই। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দেখা দেখে মেলে উৎসবের ৩-৪ দিন এরপর কালেভদ্রে। অফিসটি সবসময় তালামারা থাকে। রাত হলে এখানে বসে নেশাখোরদের আড্ডা।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও সমাজসেবক রফিকুল ইসলাম বাপ্পী বলেন, ‘মহাশ্মশাটি নিয়ে কাউন্সিলর চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসানী আন্তরিক ছিলেন না। তিনি দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন। কিন্তু এটি নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। বরং তিনি সম্প্রতি শুরু হওয়া মাটি ফেলার কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।’
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনীর মুঠোফোনে শুক্রবার বিকেল ৪টা ৫৯ মিনিটে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি সভায় আছে বলে জানিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেন। এরপর সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে ফোন করা হলে তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।
জানা যায়, সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট অভয়মিত্র মহাশ্মশানে যাতে জোয়ারের পানি না ঢোকে সে জন্য শ্মশান উঁচুকরণ, আশ্রয় শেড নির্মাণ, গ্যাস ও লাকড়ির চুল্লি উঁচুসহ এ শ্মশানের সংস্কারকাজ অবিলম্বে শুরু করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া আরেক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন গত বছরের ১৮ নভেম্বর মহাশ্মশানের চুল্লি ও জোয়ারের পানি-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশ্বাস আর বাস্তবে রূপ পায়নি।
২০১৪ সালে চট্টগ্রামের বলুয়ারদীঘি অভয়মিত্র মহাশ্মশানকে অনিবার্য বিপর্যযের হাত থেকে রক্ষার দাবি জানান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। তিনি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তৎকালীন মেয়রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রীপ্রকাশ দাশ অসিত জানান, সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সাথে আলোচনা সভায় বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। তখন উনি জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বিজয় কৃষান ও আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লালকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সভার এক পর্যায়ে একজন বলে উঠলেন এটি সিটি করপোরেশনের বিষয়। এই কথা নিয়ে তুমুল কাণ্ড হয়েছিলো সে সময়।’
ফেসবুকে অশোক চক্রবর্তী নামে একজন লেখেন ‘বিগত ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে এই বলুয়ার দীঘি শ্মশান বিষয়ে যে সব কমিটি ছিল তারা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পূর্ববর্তী কমিটি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নতুনদের সুযোগ করে দিলে সবার জন্যে মঙ্গল হতো। অনেক তো হয়েছে। উন্নয়ন করার ইচ্ছে থাকলে বিগত ২০ বছরেই হতো।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন সুপ্রভাতকে বলেন ‘আমি কাল (শনিবার) সরেজমিন পরিদর্শনে যাব এবং সমস্যাগুলো দেখব। এরপর কি করা যায় তারপর প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেব।’
এদিকে, শিক্ষা-উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী গতকাল শুক্রবার চার লাখ টাকা অনুদান প্রদান করেছেন। এরমধ্যে তিন লাখ টাকা মহাশ্মশানের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এবং বাকি ১ লাখ টাকা একটি কালী মন্দিরের জন্য। ভবিষ্যতেও মহাশ্মশানের উন্নয়নে তার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে জানান অভয়মিত্র মহাশ্মশান পরিচালনা পরিষদের সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী।