দাবা  ও বাবা

তন্ময় ইমরান :

দাবার চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার রাতে বাড়িতে খুব একটা উৎসব হলো। ক্যাসিলভের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে মাত্র ১৩১ চালে হারানোটা সহজ নয়।

ক্যাসিলভ এইদিন বেশ অমনোযোগী ছিলেন। অস্থির ছিলেন। সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। দাবা খেলার প্রথম নিয়মই হলো দাবার অসীম জগতে মনের অনুপ্রবেশ ঘটানো। আমি আসলে এ সুযোগটাই নিয়েছি। নতুবা আমার মতো সাধারণ মানের গ্র‍্যান্ড মাস্টারের ক্যাসিলভের মত দাবার প্রডিজির বিপক্ষে জেতা সম্ভব নয়।

আমি জেতার পর আমার ৬ বছর বয়সী কন্যা মোচোমোচো আমাকে উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরলো। গাড়ি সাথে ছিল। তবু আমি মোচোকে কাঁধে নিয়ে স্ত্রীর সাথে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি যে খুব কাছে তা নয়। তবে জয়ীর বেশে শহরের রাস্তায় হেঁটে মানুষের অবাক ও প্রশংসার দৃষ্টি কুড়ানোর মত সুখ আর নেই। পত্রিকার পাতায় ছবি আসবে। আমার এই অসামান্য জয়ের পর কন্যা কাঁধে শহরের রাস্তায় স্ত্রীর সাথে হাঁটার ছবিটা দৃশ্যগতভাবে অনিন্দ্য সুন্দর হবে। আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলাম- হারি বা জিতি এটা আমার জীবনের শেষ দাবার টুর্নামেন্ট।

দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। আমি কখনোই ক্যাসিলভের সাথে জিতিনি। এমনকি তার কাছাকাছি মানের আরো দু-চারজন দাবাড়–কেও হার মানাতে পারিনি। এই টুর্নামেন্টে অবশ্য কেবল ক্যাসিলভই ছিলেন। বাকিরা অংশ নেননি।

সন্ধ্যার পর বাড়িতে ওয়াইন আর শ্যাম্পেনের বন্যা বইলো। ক্যাসিলভও এলেন কন্যা কাতালিনা ও স্ত্রী নাবিলাকে নিয়ে।

ক্যাসিলভের কন্যা আমার কন্যার জানেমানে বন্ধু। স্কুল থেকে শুরু করে অবসর সময় পর্যন্ত তারা একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। আমাদের দুই পরিবারের বন্ধুত্বও খুব দৃঢ়।

আমি ও আমার স্ত্রী এইদেশে অভিবাসী। আমাকে আক্ষরিক অর্থেই একটা কেরানির চাকরি করতে হয়। আমার স্ত্রীকেও খেটে খেতে হয়। অন্যদিকে কাসিলভরা এ অঞ্চলের বনেদি পরিবার। কাসিলভ একজন পেশাদার দাবাড়ু। দাবা খেলাই তার পেশা।

রাতের পার্টিতে আমরা দাবা নিয়ে আলাপ করলাম না। রাজনীতি ও সীমান্তে অস্থিরতা নিয়ে আলাপ করলাম। এটা একটা শিষ্টাচার যে পরাজিত ব্যক্তির সাথে খেলার বিষয় নিয়ে আলাপ না করাই ভালো, যদি না সে নিজ থেকে কিছু বলে। যদিও রাজনীতি ও সীমান্তে অস্থিরতা নিয়ে আমার জ্ঞান তো দূরে থাক তথ্যও জানা ছিল ভাসাভাসা, তবু এইদিন আমি বেশ চড়া গলায় বেশ বড় বড় লেকচার দিতে লাগলাম। উপস্থিত অতিথিরা আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রজ্ঞার ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলো। এমনকি আমার বন্ধু রাশান জাগারভ, ভারতীয় সুশীল মুখার্জি এবং ইউক্রেনের ইউভচেনকা- যারা আমাকে নানা আড্ডায় নেশা চড়ার পর রাজনৈতিক প্রতিবন্ধী বলে, তারাও এইদিন আমার রাজনীতি দেখার চোখকে ‘নয়াদর্শনের উন্মোচন’ বলে প্রশংসা করলো। আহ একটি জয়- কত কিছু পাল্টে দেয়!

আমার জীবনের সবচেয়ে সার্থক দিনটি ফুরালো। রাতে শুতে যাওয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করলাম। কন্যা মোচোকে একটু সময় দেব। ওকে এবছর আলাদা রুমে দিয়েছি। সফলতার এই দিনটি অবশ্যই শেষ হতে হবে স্ত্রী তানিয়ার সাথে একটা মধুর সেক্স দিয়ে।

আমি মোচোর রুমে গেলাম। মোচো শুয়ে আছে, জেগেই আছে। কি একটা কাগজ যেন দেখছে।  খেলার সময় তার কী মনে হচ্ছিল সেটা শুনতে ভালো লাগবে। আমি কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলালাম।

– কী দ্যাখো বাবা!

– বাবা এটা একটা চিঠি।

– ও আচ্ছা।

আমার ঠিক চিঠির আলাপে যেতে ইচ্ছা করলো না। তাছাড়া মোচো না বললে আমিও জিজ্ঞাসা করবো কার চিঠি। এই পারসোনাল স্পেসের জায়গা এখন থেকে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি ও তানিয়া।

আমি ওর মাথায় বিলি কাটতে লাগলাম। হঠাৎই মনে হলো- মোচোর চোখ চিকচিক করছে। সে মনে হয় খুশির কান্না আটকাচ্ছে! আমার বুক ভরে গেল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম- কী ব্যাপার মোচো তোমার মন খারাপ!

আমার ধারণা ছিল মোচো বলবে- না বাবা আমি খুব হ্যাপি। কিন্তু সে মাকে বিস্মিত করে দিয়ে- মাথা নাড়লো, মানে তার মন খারাপ। তারপর শোয়া থেকে বসে আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।

আমি প্রচ- ধাক্কা খেলাম। এই সুখের দিনে কেন আমার মেয়েটার মন খারাপ! তারপর মনে হলো- চিঠিটার কথা জিজ্ঞাসা করি। আমি বললাম- চিঠি পড়ে মন খারাপ মোচো?

মোচো আমার বুক থেকেই মাথা নাড়লো ‘হ্যাঁ’।

– আমি কি চিঠিটা পড়তে পারি?

মোচো চিঠিটা আমার হাতে দিল। কাসিলভের কন্যা ও মোচোর বান্ধবী কাতালিনার লেখা। সে তার কাঁচা হাতে যা লিখেছে তার সারমর্ম হলো- আঙ্কেল অসম্ভব ভালো। তাকে অভিনন্দন। খুব ভালো খেলেছে। আমার বাবাও আরেকটু ভালো খেলতো। কিন্তু কাল আমার মাথার অসুখটা খুব বেশি ছিল।

মোচো আমার বুকে তখনো লেপ্টে আছে। আমি কোনো কথা বললাম না। খেলায় কাসিলভের অমনোযোগী থাকার কারণটা বুঝলাম। আচ্ছা কাতালিনার কি খুব বড় অসুখ! ব্রেন টিউমার টাইপের? নাকি নিছক মাইগ্রেন?

চিন্তা বেশিদূর আগানোর আগেই মোচো আমার বুকের মধ্য থেকে হস্ফুটে একটা প্রশ্ন করলো- আচ্ছা বাবা পৃথিবীতে এমন কোনো খেলা নেই, যেখানে কারো বাবাই হারবে না!