দখল-দূষণে কাপ্তাই হ্রদ : ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি প্রয়োজন

দক্ষিণ এশিয়ার নয়নাভিরাম কাপ্তাই হ্রদ, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আধার। এটি রাঙামাটি শহরকে জালের মতো ঘিরে রয়েছে। এই জেলার মানুষের জীবন জীবিকার সাথে জড়িয়ে আছে হ্রদ, রাঙামাটি জেলার কয়েকটি উপজেলাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক দীর্ঘ নৌপথ যা এই জেলার পণ্য ও যাত্রী চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পর্যটন, নৌ চলাচল, মৎস্য ও নানা জীবিকার কারণে কেবল আঞ্চলিক অর্থনীতি নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করছে। কিন্তু আমাদের অদূরদর্শী কর্মকা-ের ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্মিত কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট এই হ্রদটি ঘিরে পরিকল্পনা নিলে আঞ্চলিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতে পারতো। এখন অব্যাহত দখল দূষণে বিবণর্, জর্জরিত হয়ে পড়েছে কাপ্তাই হ্রদ। আমাদের রাঙামাটি প্রতিনিধির পাঠানো এক সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হ্রদের পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা হচ্ছে সুরম্য অট্টালিকা বসত বাড়ি হোটেলÑ মোটেল প্রভৃতি, এতে হ্রদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যই বদলে যাচ্ছে। মনুষ্য ও নানাবিধ স্থাপনা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে হ্রদ। এই অবস্থা চলতে থাকলে হ্রদটি পর্যটকদের আকর্ষণ হারাবে। শুধু তাই নয়, হ্রদের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। হ্রদটি একসময় দেশের মৎস্যভা-ারে অবদান রেখেছে, সেখানে মৎস্য উৎপাদন, বিশেষ করে কার্প মাছের উৎপাদন একেবারে হ্রাস পেয়েছে। লেকের চারপাশের বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষের পানীয় জল, রান্না, গোসল ও নিত্য ব্যবহারের উৎস এই হ্রদের পানি, দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকিও সৃষ্টি হয়েছে।
কাপ্তাই হ্রদের এই অবর্ণনীয় দশা ক্রমাগত উপেক্ষা করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ। জেলার বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যেমন পৌরসভা, বাজার ফান্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্থা হ্রদটির এই দখল দূষণ প্রক্রিয়া নির্বিকার অবলোকন করেছে। হ্রদের ওপর স্থাপনা নির্মাণে অনুমতি দিয়েছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ কিছুটা ইতিবাচক হলেও হ্রদটির সৌন্দর্য ও উপযোগিতা ফিরিয়ে আনতে সরকারি প্রশাসন ও নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুতের দেখাশোনার দায়িত্ব বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের, আছে পরিবেশ অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ডÑএতগুলি সরকারি সংস্থা থাকলেও কেবল আন্তঃবিভাগ সমন্বয়ের অভাবে হ্রদটি এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
হ্রদটির দখলÑদূষণ বন্ধ করা না গেলে ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য ও মানুষের জীবন জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। আমরা মনে করি, সরকারের উর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপ ও বিস্তৃত পরিকল্পনা ছাড়া হ্রদটির সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনউপযোগিতা রক্ষা করা কঠিন হবে। এ জন্য কাপ্তাই হ্রদের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠন করা অথবা প্রত্যক্ষÑপরোক্ষভাবে যে সকল সংস্থা এই হ্রদটির দেখভালের নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ, তাদের সমন্বয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। জাতীয় নদী কমিশনকে উচ্চ আদালত দেশের নদÑনদী ও জলাশয়ের আইনি অভিভাবক ঘোষণা করেছে। কমিশন দেশের নদী দখলদারদের তালিকা করেছে। কিছু প্রতিকারমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে। আমরা চাই, দেশের এই শ্রীম-িত হ্রদটির দখলÑদূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। সেই সাথে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল হ্রদটির উন্নয়ন ও এর থেকে বিবিধ উপযোগিতা পেতে সংশ্লিষ্টদের দিক নির্দেশনা দেবে।