দখলে-দূষণে বিবর্ণ কাপ্তাই হ্রদ

ফজলে এলাহী, রাঙামাটি >>
হ্রদ-পাহাড়ের পার্বত্য শহর রাঙামাটিকে জালের মতোই তিনদিক ঘিরে আছে অপরূপা কাপ্তাই হ্রদ। ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়াসের জেরে সৃষ্ট এই হ্রদ এখন এই জেলার মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়া এক জলপ্রবাহের অন্য নাম। শুধুই কি খাবার, ব্যবহারের পানিরও প্রধান উৎস। হ্রদের পথ ধরেই বিস্তৃত পথ পাড়ি দিয়েই পৌঁছাতে হয় জেলার অন্তত সাতটি উপজেলায়, যার মধ্যে পাঁচটিতে পৌঁছানোর একমাত্র পথই এই হ্রদের বুক চিড়ে বহমান নৌপথ।
প্রায় ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই হ্রদে ৭৩ প্রজাতির বিভিন্ন মাছের বাস, যার মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকভাবে আহরিত হয় অন্তত ৩৪ প্রজাতি। ছোট ছোট মলা ঢেলা কাঁচকি চাপিলার সাথে বড় বড় রুই কাতলা বোয়াল এই হ্রদের জলের সঙ্গী।
এ জেলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতেও আছে হ্রদে নৌভ্রমণ কিংবা হ্রদের জলরেখা ধরে ঘুরে আসা কাপ্তাই, সুভলং, বরকল কিংবা লংগদু’র পথ। সুবিশাল নীল জলরাশি, চারপাশে বিস্তৃতি বিশাল সবুজ সব পাহাড়, এমন চমৎকার প্রাকৃতিক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে এই হ্রদে, যেনো শিল্পীর নিজ হাতে গড়া শিল্পকর্ম।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ধীরলয়ে বদলাচ্ছে হ্রদের চিত্র। হ্রদের পাড় ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে সুরম্য অট্টালিকা, বাড়িঘর, বসত, হোটেল-মোটেল। এইসবের বর্জ্যও নিরাপদে বহমান হ্রদে। এ নিয়ে প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই, যেনো সবার খেয়াল খুশিমতই চলছে সবকিছুই।
যেভাবে জন্ম কাপ্তাই হ্রদের
১৯৫৬ সালে তৎকালিন পাকিস্তান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে প্রমত্তা কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে, যা ১৯৬২ সালে শেষ হয়, যেটি কাপ্তাই হ্রদ নামে পরিচিতি লাভ করে।
ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ্ ইন্টারন্যাশনাল ইনকরপোরেট নামের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এই বাঁধটি নির্মাণ করে। এতে ১৬টি স্প্রিলওয়ে বা জলকপাট রাখা হয়, যা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক পানি নির্গমন করতে পারে। প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই বাঁধে ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে আছে।
প্রথমে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছিলো ১ লাখ ২০ হাজার কিলোওয়াট। শুরুতে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১ ও ২ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হলেও পরে ১৯৬৯ সালের ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের মাধ্যমে উৎপাদন শুরু হয়। এরপর যুক্ত হয় আরো দুটি ইউনিট। বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে, যার মাধ্যমে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট।
আর এই বাঁধের ফলে পুরনো রাঙামাটি শহরসহ পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ৫৪ হাজার একর ফসলি জমি ও সমতলভূমি। ফলে সৃষ্ট হ্রদের মূল আয়তন ১,৭২২ বর্গকিলোমিটার। মূলত রাঙামাটি জেলাতেই হ্রদটি বিস্তৃতি ছড়িয়েছে- রাঙামাটি সদর, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলায়।
কি ভূমিকা রাখছে হ্রদ?
শুধুই কি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন? এছাড়া হ্রদটির মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ, নান্দনিক ও অসাধারণ দীর্ঘ এক জলপথের সৃষ্টি হয়েছে। দূর পাহাড়ের প্রত্যন্ত গাঁয়ে সহজেই পৌঁছে নিয়ে যাচ্ছে হ্রদ, নৌ যোগাযোগে গতি বেড়েছে পাহাড়ীয়া জীবনে। যে পথ আগে দীর্ঘ সময়েও অতিক্রম করা যেতোনা ,হ্রদের কারণে খুব সহজেই সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে পণ্য ও মানুষ। বনজসম্পদ আহরণ ও বাজারজাতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এ হ্রদ, বেড়েছে হ্রদনির্ভর অর্থনীতির গতিও। হ্রদের মৎস্যসম্পদ হয়ে উঠেছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে। বছরে সাত হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি মাছ আহরিত হয় এই হ্রদ থেকে। জেলা শহর ও উপজেলাগুলোর মানুষের খাবার ও ব্যবহার্য পানির প্রধান উৎসও হয়ে উঠেছে এই হ্রদ।
দূষণে দখলে বিবর্ণ হ্রদ
রাঙামাটি শহরের যে কোন নৌঘাট থেকে একটি ইঞ্চিনচালিত বোট নিয়ে কাপ্তাই হ্রদে নামলেই হতবাক হতে হবে। যেনো হ্রদের উপর ঝুলছে পুরো একটি শহর। তিনদিকে হ্রদ বেষ্টিত এই শহরের সবচে বেশি বেদখল চোখে পড়বে রিজার্ভবাজারে। পুরো বাজারের চারপাশে যে যার মনের খুশিমতো ভবন নির্মাণ করেছে হ্রদের উপর এসে। যেনো পুরো হ্রদটাই কারো বাপের তালুক। এসব স্থাপনা ও ভবনের আবার অনেকগুলোরই বাজার ফান্ডের বন্দোবস্তিও আছে! এরপর শহরের গর্জনতলী, বনরূপা, তবলছড়ি, আসামবস্তি সর্বত্রই ব্যাপকহারে চলছে দখলবাজি। শুধু দখলই নয়, এসব বসতবাড়ির বর্জ্য ও পয়ঃ সবই নিক্ষেপ হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের জলে! অথচ এই হ্রদের পানি খাবার ও ব্যবহার করছে জেলার ৮৫ শতাংশ মানুষ। দূষণ আর দখলে ব্যবহার অনুপযোগী হচ্ছে হ্রদের পানি। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হ্রদের মাছ উৎপাদনেও।
১৯৬৬ সালে যেখানে মোট মাছ উৎপাদনের মধ্যে বড় মাছের অংশ ছিল ৭৮%, ১৯৯৩ সালে তা মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে। এ ছাড়া প্রতিদিন লেকটিতে ৫ টনেরও বেশি মনুষ্য বিষ্ঠা ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। লেকের চারপাশের ৮৫ শতাংশ মানুষই পানীয় জল, রান্না, ধোয়া-মোছা, গোসল ইত্যাদির জন্যে এ লেকের পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি ভয়ানক বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ রাঙামাটি শহরে যে পানীয় জল সরবরাহ করছে তাতেও জীবাণুর অনুপাত গ্রহণযোগ্য মাত্রার ১০ গুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, ফ্রেশ ওয়াটার রিসার্চ সাব-স্টেশন এবং অ্যাকুয়াটিক রিসার্চ গ্রুপ মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের রেকর্ড থেকে দেখা গেছে, হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন দারুণভাবে কমে গেছে, বর্তমানে হেক্টর প্রতি লেকের মাছের উৎপাদন বর্তমানে ১০০ কিলোগ্রামের বেশি। রুই জাতীয় মাছের উৎপাদনের অনুপাত ধীরে ধীরে কমে আসায় এখন যে দুটি প্রজাতির মাছ সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ছে সেগুলি হচ্ছে চাপিলা ও কাচকি।
কি ভাবছেন নাগরিক সমাজ
রাঙামাটি সরকারি কলেজের সাবেক জিএস ও নাগরিক আন্দোলনের কর্মী জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলছেন, কাপ্তাই হ্রদ দখল বন্ধে সবচে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা এই জেলার রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারাই সবচে কম দায়িত্ব পালন করেছে, ফলে যা হবার তাই হয়েছে। এসব রোখার যেনো কেউই নেই।
রাঙামাটির প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক সংবাদের পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি সুনীল কান্তি দে বলেন, এই হ্রদের উপর ভূমি বন্দোবস্তি দিয়ে প্রকারান্তরে হ্রদ দখলের সহযোগী হিসেবে সবচে বড় অপকর্মটি করছে বাজারফান্ড প্রশাসন। সমতলের সাথে পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সুযোগ অপব্যবহার করে এই প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্বহীন কার্যক্রমের কারণে হ্রদের তীরবর্তী স্থানে বসতবাড়ি, দালানকোটা গড়ে উঠছে। এখনই যদি এসব বন্ধ করা না যায়,তবে ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে।’
রাঙামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ললিত সি চাকমা বলেন, ‘ হ্রদ ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত আছেন, তাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে। যেসব বিভাগ ও সংস্থা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হ্রদের উপকারভোগী তাদেরও নিজ কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। ভুলে গেলে চলবেনা, এই হ্রদ এখন জেলাবাসীর খাবার, ব্যবহার্য পানির যেমন প্রধান উৎস, তেমনি নৌ যোগাযোগেরও একমাত্র মাধ্যম।’
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজ রাঙামাটির পরিচালক হেফাজত উল বারি সবুজ বলেন, এই শহরে হ্রদ দখল করা ফ্যাশন আর ঘরের যাবতীয় বর্জ্য হ্রদের জলে ফেলা ফ্যাশন। এসব বন্ধ করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন জরুরি, তেমনি এই হ্রদ ব্যবস্থাপনায় একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ জরুরি। সেই সাথে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।’
দূষণ বা বেদখল নিয়ন্ত্রণে নেই কেউই!
মজার ব্যাপার হলো, রাঙামাটি জেলাজুড়ে কাপ্তাই হ্রদ দূষণ ও দখলের জন্য শুধু বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই নয়, জড়িত আছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পার্বত্য জেলা পরিষদ হ্রদের জায়গা দখল করে শহরের শহীদ মিনার এলাকায় ফাইভস্টার হোটেলের উদ্যোগ, জেলা প্রশাসনের বাধায় ব্যর্থ হওয়ার পর, তবলছড়ি এলাকায় অভিজাত ফ্রেন্ডস ক্লাব নির্মাণ কাজে অর্থায়ন করেছে। জাতীয় নদী কমিশন, স্থানীয় পরিবেশবাদি ও এলাকাবাসীর বিরোধীতায় বর্তমানে যার নির্মাণকাজ বন্ধ। তবে রিজার্ভবাজার এলাকায় শহীদ আব্দুল আলী একাডেমির সামনে লেকের উপর বাণিজ্যিক কমিউনিটি সেন্টারের বহুতল ভবন নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ পার্বত্য শান্তিচুক্তি মোতাবেক, কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা এ প্রতিষ্ঠানটির।
শুধু রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদই নয়, হ্রদে দূষণ বা দখলে কোন ভূমিকাই পালন করছে না রাঙামাটি পৌরসভাও। বরং পৌরসভার মালিকানাধীন পৌর মার্কেট নির্মিত হয়েছে হ্রদের প্রবাহের উপরই। একই সাথে বর্তমানে নির্মাণাধীন পৌরভবনটিও নির্মিত হচ্ছে হ্রদের উপর! পৌরসভার ইতিহাসে কখনই হ্রদ দখলকাদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কোন উদ্যোগই চোখে পড়েনি।
তবে কিছুটা হলেও হ্রদ রক্ষায় ভূমিকা পালন করছে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন। হ্রদ দখলের খবর পেলেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, বাধা দেয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে তারা। নির্মাণাধীন পাঁচতলা হোটেলের কাজ বন্ধ, ফ্রেন্ডস ক্লাব ভবন নির্মাণ বন্ধ করে দেয়া, ফায়ার সার্ভিস ও আসামবস্তি এলাকায় হ্রদ দখল করে নির্মিত একাধিক ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ করেছে তারা গত এক বছরে।
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ বলেন, দেখুন আমরা নির্ধারিত সময়ের জন্য এখানে চাকরিতে আসি, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি এই হ্রদকে রক্ষা করতে। কিন্তু এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষকেই। এদের সবাইকে মনে রাখতে হবে এই হ্রদের সাথেই মিশে গেছে তাদের জীবন ও জীবিকা। আমরা তো এককভাবে অনেক কিছুই করতে পারি না, সম্ভবও নয়। তবুও চেষ্টা তো করছি।