ড. আনিসুজ্জামান : শিক্ষক থেকে জাতির অভিভাবক

কামরুল হাসান বাদল:

ড. আনিসুজ্জামানের যে বহুরৈখিক প্রতিভা, পরিচয় এবং অভিধা তার সবটুকু আড়াল করে বড় বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ‘জাতির অভিভাবক’ তাঁর এই পরিচয়টি।
জীবন শুরু করেছিলেন সাধারণত মেধাবী শিক্ষার্থীরা যা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা দিয়ে। সেই যে শিক্ষকতায় ঢুকলেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি মূলত শিক্ষকতাই করে গেলেন। জাতি বা রাষ্ট্রের যেকোনো দুর্যোগে তিনি অভিভাবকের মতো পথ বাৎলে দিয়েছেন, সত্যটুকু নির্ভয়ে প্রকাশ করেছেন তাতে কেউ মনোক্ষুণœ হতে পারে সে ভাবনা তিনি ভাবেননি।
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের যে সংকট তা তিনি খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং সেই বিষয়ে তিনি অত্যন্ত খোলামেলা মত প্রকাশ করেছেন। তার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট এবং দ্বিধাহীন। তিনি যা বলতেন, লিখতেন তা তাঁর বিশ্বাস থেকেই করতেন, যে কারণে তিনি আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের পক্ষে থেকেছেন এবং এর জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।

উল্লেখ করার মতো দেশের সমস্ত পুরস্কার এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মানও অর্জন করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনও আত্মপ্রচারে নিমগ্ন হন নি। অন্যের স্বার্থ রক্ষায় যেমন করে সোচ্চার থেকেছেন তেমন করে কিন্তু নিজের বেলায় থাকেননি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। তবে তার আগেই তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর গবেষণাকর্মের কারণে ওপার বাংলার সুধীমহলে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা অনুলিপি তার হাত দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি প্রথম শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।

সদালাপী বন্ধুবৎসল ড. আনিসুজ্জামান তাঁর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেও সারাজীবন স্নিগ্ধ ও সংবেদনশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়াও ছিল সংযত কিন্তু অত্যন্ত সংহত। তাঁর পা-িত্য ও ব্যক্তিত্বই তাঁকে জাতির অভিভাবকে পরিণত করেছিল। ‘তাঁর মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি’ এমন প্রতিক্রিয়া সচরাচর উচ্চারিত হলেও ড. আনিসুজ্জামানের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত রুঢ় বাস্তব হয়ে উঠবে কারণ, তার মতো শিক্ষকতুল্য অভিভাবক তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তার মৃত্যুকে অকাল কিংবা আকস্মিক বলা যাবে না। তারপরও তার শূন্যতা বাঙালির বুকে বড় ব্যথা হয়ে বাজবে দীর্ঘদিন। বিশ্বব্যাপী মহামারি দুর্যোগকালে তার মৃত্যুতে এই মুহূর্তে তাঁর অগণিত ভক্ত, অনুগ্রাহী, প্রিয়জনেরা একত্রিত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারবে না বটে কিন্তু বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে, বাঙালির অন্তর থেকে তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের কোনও কমতি হবে না।