চিকিৎসক আক্রান্তের নেপথ্যে

3D illustration of Coronavirus, virus which causes SARS and MERS, Middle East Respiratory Syndrome

চট্টগ্রামে এপর্যন্ত ২৮৪ জন চিকিৎসক আক্রান্ত, মারা গেছেন ১০ জন#
মহামারি মোকাবেলায় প্রস্তুত নয় আমাদের হাসপাতালগুলো: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রোবেদ আমিন
করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চমেক হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক এখনো আক্রান্ত হননি: পরিচালক
করোনা থেকে বাঁচতে সব রোগীকে দেখতে শতভাগ নিরাপত্তা উপকরণ নিতে হবে: চিকিৎসকবৃন্দ

ভূঁইয়া নজরুল :
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন মহিদুল হাসান। প্রতিদিন রোগী দেখতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন এবং পরবর্তীতে গত ৪ জুন মারা যান। একইভাবে অর্থোপেডিক্স বিভাগের ডা. সমিরুল ইসলাম বাবু সাধারণ রোগী দেখতে গিয়ে আক্রান্ত হন এবং অনেকদিন অদৃশ্য এই শক্তির সাথে লড়াই করে মারা যান। মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের ডা. এহসানুুল করিমও সাধারণ রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। সর্বশেষ গত ২৪ জুন বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুল আনোয়ারও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এপর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হওয়া কিংবা আক্রান্তের পর মারা যাওয়া চিকিৎসকদের তালিকায় বেশিরভাগ ডাক্তারই সাধারণ রোগী দেখতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আর দিন দিন এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।
তাহলে কি করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতরা আক্রান্ত হচ্ছেন না? যদি তাই হয় তাহলে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় একাধিক চিকিৎসক, প্রশাসন ও মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষদের সাথে।
এবিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমার হাসপাতালে রেডজোন (শতভাগ করোনা রোগী) এবং ইয়েলো জোন (করোনা উপসর্গের রোগী) এ নিয়োজিত কোনো চিকিৎসক এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হননি।’
এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন,‘যেসব ডাক্তার মারা গেছেন তাদের কেউ রেড জোন কিংবা ইয়েলো জোনে কর্মরত ছিলেন না। সাধারণ রোগী দেখতে গিয়ে তারা আক্রান্ত হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগে অনেক ধরনের রোগী আসে তাদেরকে ডাক্তার দেখেন। কিন্তু তা দেখতে গিয়ে স্পেশালি করোনা রোগীর জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা উপকরণ চিকিৎসকরা নিয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে অনেক সময় তা হয়ে উঠে না। গাইনি ওয়ার্ডে চিকিৎসক রোগীর ডেলিভারি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে কিন্তু সেই রোগীর মধ্যে করোনা আছে কি নাই তাতো চিকিৎসকের জানার কথা নয়, একইভাবে হার্টের সমস্যা নিয়ে রোগী হার্টের ডাক্তারের কাছে আসে, চোখের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে রোগী আসছে। এতে আক্রান্ত হচ্ছে ডাক্তাররা।’
তিনি আরো বলেন, রেড ও ইয়েলো জোনের ডাক্তারদের জন্য পিপিই পরার জন্য ডনিং রুম এবং পিপিই খোলার জন্য ডফিন রুম রয়েছে। সম্পূর্ণ বিধিনিষেধ মেনে কাজ করছেন এখানকার ডাক্তাররা। তাই করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতদের মধ্যে আক্রান্তের হার কম। বহির্বিভাগে এবং অন্যান্য ওয়ার্ডে রোগী দেখতে গিয়ে ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছেন।
চিকিৎসকরা সামনের সারির যোদ্ধা বলেই আক্রান্তের হার বেশি বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. শামীম হাসান। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকরা রোগীর খুব কাছে গিয়ে রোগী দেখছেন এতেই তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। পেশাগত কারণে তাদের রোগী দেখতে হবে।’
কী সংখ্যক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের ডা. তারেকুল কাদের বলেন, ‘চট্টগ্রামে এপর্যন্ত ২৮৪ জন (২৬ জুন পর্যন্ত) চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং এদের মধ্যে মারা গেছেন ১০ জন। এই ১০ জনের মধ্যে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক রয়েছেন তিনজন এবং বাকিরা প্রাইভেট বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।’ অপরদিকে সারাদেশে এপর্যন্ত ৬১ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রথম থেকেই করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে ১০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়ে হাসপাতালটির সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই রোগীদের করোনা রোগী মনে করে চিকিৎসা দিচ্ছি। মূলত শতভাগ সেইফটি উপকরণ নিয়ে রোগী দেখা হয় না বলেই ঝুঁকিতে পড়ছে চিকিৎসকরা। এখন সারাদেশের সব রোগীকে করোনা রোগী ভেবেই চিকিৎসককে রোগী দেখতে হবে। তবেই চিকিৎসকরা নিরাপদ থাকতে পারবে।’
মহামারিতে সাতটি উপকরণের সপ্তমটি হলো পিপিই
মহামারি আকারে যখন কোন রোগ ছড়িয়ে পড়ে তখন ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোল (আইপিসি) নামে একটি বিষয় থাকে। সেই আইপিসে তে সাতটি নিয়ামকের মধ্যে সপ্তমটি হলো চিকিৎসকদের জন্য পিপিই বলে উল্লেখ করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর ও বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রোবেদ আমিন। বর্তমানে করোনা শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চিকিৎসকদের গ্রুপে এক ভিডিও ক্লিপে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালগুলোতে ডনিং (পিপিই পরার রুম) ও ডফিন (পিপিই খোলার রুম) নেই, আবার থাকলেও সেখানে সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল। একারণে পিপিই পরতে ও খুলতে গিয়ে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া হাসপাতালগুলোর ক্লিনিং, সুয়্যারেজ, পানির লেভেল, ভবনের কাঠামোসহ সব ধরনের ব্যবস্থা মহামারী ঠেকানোর জন্য মোটেও উপযোগী নয়। অনেক সময় পিপিই পরে একজন ডাক্তার সাধারণ ওয়ার্ডে চলে যাচ্ছেন এতে তিনি ভাইরাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে মেডিক্যালগুলোতে করোনা ছড়াচ্ছে।’
এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালগুলোতে প্রকৃতপক্ষে মহামারি সময়ে চিকিৎসকদের সুরক্ষা দেয়ার বিষয়টি নেই। একইসাথে পরা ও খোলার জন্য দুটি পৃথক রুম থাকার কথা সব হাসপাতালে থাকার কথা থাকলেও তা যথোপযুক্তভাবে নেই। করোনা রোগীরা যে ওয়ার্ডে থাকছে সেখানে ভাইরাসের ঘনত্ব অনেক বেশি, এই বেশি ঘনত্বের ভাইরাস সহজে চিকিৎসকদের মাস্ক বা কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে চিকিৎসকদের শরীরে প্রবেশ করছে এবং তারা আক্রান্ত হচ্ছে।’
চট্টগ্রামে যেসব চিকিৎসক করোনায় মারা গেলেন
২২মে চট্টগ্রামে করোনায় প্রথম মারা যাওয়া চিকিৎসক হলেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ডা. জাফর হোসেন রুমি। এরপর থেকে এপর্যন্ত ১০ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। এর হলেন- মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এহসানুল করিম (৩ জুন), চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মহিদুল হাসান (৪ জুন), জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক সাদেকুর রহমান (১৪ জুন), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার ডা. নুরুল হক (১৭ জুন), কক্সবাজারের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. আবদুল হাই (২০ জুন) এবং কক্সবাজারের আরো একজন চিকিৎসক আবু বকর সিদ্দিক, নাক কান গলার বিশিষ্ট চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্ধা ডা. ললিত কুমার দত্ত (২২ জুন), চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সমিরুল ইসলাম বাবু ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুল আনোয়ার (২৪ জুন)।