চাই বে টার্মিনালের দ্রুত বাস্তবায়ন

রুশো মাহমুদ »

হালিশহর উপকূল। বিস্তীর্ণ ভূমি এবং জেগে ওঠা চর। সেই চরে তৈরি হওয়া একটি চ্যানেলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দেখছে একটি বড় স্বপ্ন। বন্দরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও নৌ বাণিজ্যের অমিত সম্ভাবনা।

আরব ভূগোলবিদদের ‘সমন্দর’ বা পর্তুগীজদের ‘পোর্ত্তে গ্রান্ডি’, বড় বন্দর চট্টগ্রাম। প্রকৃতির হাতে গড়া পোতাশ্রয়। তারপর ক্রমে ক্রমে আজকের সমুদ্র বন্দর।

বিশ্বায়ন, বড় হতে থাকা চাহিদা ও সরবরাহের অর্থনীতি, প্রযুক্তির উন্নয়ন বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে নৌপথের বাণিজ্যে। পাল তোলা জাহাজের পরিবর্তে গভীর ড্রাফটের বিশাল বিশাল জাহাজ এখন পণ্য পরিবহন করছে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কিছুটা দূরে কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বন্দর দিন দিন লাইটার জাহাজের বন্দরে পরিণত হতে চলেছে। ৯ মিটার বা তার চেয়ে কম ড্রাফটের জাহাজ ছাড়া এখানে ভিড়ানো অসম্ভব। ফলে বহির্নোঙ্গরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে লাইটারেজে। সাথে জোয়ার ভাটার সময়ক্ষেপণতো আছেই। অথচ জেটির গভীরতা দুই/তিন মিটার বেশি হলেই অনেক বড় বড় জাহাজ ভিড়তে পারতো চট্টগ্রাম বন্দরে। সাশ্রয় হতো বিপুল অর্থের।

যে অমিত সম্ভাবনার কথা শুরুতে বলা হলো তার সূত্র ধরে একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলে একটি সময়ের দাবিকে আড়াল করা হবে। বন্দর উন্নয়ন সম্পর্কিত দাবিটি ছিলো আসলে মোটাদাগে বাংলাদেশের উন্নয়ন। বন্দর রক্ষা কমিটির ব্যানারে রাজনীতিক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সেই দাবির কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। মূলত এটি ছিলো একটি প্রস্তাব। পতেঙ্গা থেকে কুমিরা সমুদ্র উপকূলের বেসিনে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নতুন জেটি তৈরির প্রস্তাব। উপকূলে সারিবদ্ধ নোঙর করা জাহাজের সচিত্র নকশা ও লোকেশন ম্যাপ এঁকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি সেই প্রস্তাব জানান দিয়েছিলেন। প্রস্তাবের নেপথ্যে বিশেজ্ঞদের পরামর্শ ছিলো। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মহিউদ্দিন চৌধুরী উপদেশ নিয়েছেন সাবেক বন্দর চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার সুলতান মাহমদুসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

অনেকটা সময় পেরিয়ে জোরালো ও আলোচিত সেই দাবিটি কার্যত আজকের বে টার্মিনালের ভ্রুণ। পৃথিবীর নামকরা বন্দরের একটি সিঙ্গাপুর পোর্ট। এই বন্দর গড়ে উঠেছে সাগর ভরাট করা ভূমিতে। একই নজির আছে দুবাই পোর্টের ক্ষেত্রে। এই রকম বন্দরের আদলে উপকূলের প্রায় ৯০০ একর ভূমি এবং সাগরের ১৬০০ একর ভূমি উদ্ধার করে গড়ে তোলা হবে আগামী দিনের বে টার্মিনাল। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে বে টার্মিনালকে বলা হচ্ছে ভবিষ্যতের চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দরের ইতিহাসে সবচেয়ে পরিকল্পিত ও সর্ববৃহৎ সম্প্রসারণ বলা চলে।

সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধারের (রিক্লেইম) পর বে টার্মিনালের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২৫০০ একর। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল এরিয়ার পরিমাণ ৪০০ একর।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের খেজুরতলা থেকে কাট্টলী পর্যন্ত অংশে পলি জমে ১১ কিলোটিমার দীর্ঘ একটি চর সৃষ্টি হয়েছে। এই চরেই নির্মাণ করা হবে বে টার্মিনাল।

এই চর ও উপকূলের মাঝামাঝি প্রায় ৮০০ মিটার প্রশস্ত জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি হয়েছে। এই পথের গভীরতা ৭ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত। খনন করলে এই পথে ১০ থেকে ১২ মিটার ড্রাফট ও ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ চালানো সম্ভব।

চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে দিনে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ চার ঘণ্টায় নয় দশমিক ৫০ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ চলাচল করতে পারে। বে টার্মিনাল নির্মিত হলে দিনে-রাতের যে কোনো সময়ে এর চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্য ও ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে।

পাঁচটি কম্পোনেন্টের সমন্বয়ে গড়ে ওঠবে আগামীর বন্দর বে টার্মিনাল। দুটি কন্টেনার টার্মিনাল। একটির দৈর্ঘ্য ১২২৫ মিটার এবং অপরটির দৈর্ঘ্য ৮৩০ মিটার। ১৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল একটি। ৫ কিলোমিটার ব্রেকওয়াটার এবং ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং।

বন্দর পরিচালনায় অভিজ্ঞ বিশ্বের নয়টি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বে টার্মিনালের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। তালিকায় আছে বারোটি দেশে টার্মিনাল অপারেট করা খ্যাতনামা সংস্থা পিএসএ সিঙ্গাপুর, আফ্রিকাসহ নানা দেশে বন্দর নির্মাণ করে টার্মিনাল হ্যান্ডলিং করা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ড, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে বন্দর তৈরি ও পরিচালনাকারী সৌদি রাজ পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রেড সী গেটওয়ে টার্মিনাল লিমিটেড, চীনের ব্যস্ততম সাংহাই পোর্ট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মার্চেন্টস্্ পোর্ট হোল্ডিংস কোম্পানি লিমিটেড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই গ্রুপ।

এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে পিএসএ সিঙ্গাপুর কোনো ধরনের নির্মাণ কাজ করতে আগ্রহী নয়। তারা বন্দর পরিচালনা করতে প্রস্তাব করেছে। তারা নিজেরা কোনো বিনিয়োগ করবে না। তবে নির্মাণ ব্যয়ের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে দেবে বলেও প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ড প্রস্তাব করেছে যে, তারা বন্দর নির্মাণ করবে। তবে ব্রেক ওয়াটারের অংশ তারা করবে না। এটি চট্টগ্রাম বন্দরকে করে দিতে হবে। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। তবে কেউ ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে আগ্রহী নয়। শুধুমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই গ্রুপের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তারা ব্রেক ওয়াটারও করবে। পোর্টও করবে। ভূমিও তারা রিক্লেইম করবে। তারা ঋণের ব্যবস্থা করারও প্রস্তাব দিয়েছে। হুন্দাই গ্রুপ ত্রিশ বছরের চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা সবকিছু করে টার্মিনাল নির্মাণ করবে। ত্রিশ বছর পর তারা চলে যাবে। এর মধ্যে কীভাবে বন্দরটি পরিচালিত হবে, এতে বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং হুন্দাইয়ের শেয়ার কীভাবে নির্ধারিত হবে তা আলোচনা করে ঠিক করারও প্রস্তাব দিয়েছে গ্রুপ। অপরদিকে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এক শতাংশেরও কমে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরকেই বে টার্মিনাল নির্মাণ এবং পরিচালনা করতে হবে।

তথ্যগুলো নানা সূত্র থেকে পাওয়া। প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, কাজের অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে দুইটির শর্টলিস্ট করা হয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া গত ১৮ নভেম্বর নৌমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বন্দরের মাস্টারপ্ল্যান ও ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য ডিসেম্বরে পরামর্শক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই বৈঠকে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান বে টার্মিনাল দ্রুত আলোর মুখ দেখবে

বন্দরকে ঘিরে যে অপার সম্ভাবনা তা কাজে লাগাতে হবে সতর্ক বিবেচনা ও কৌশলী সিদ্ধন্ত গ্রহনের মাধ্যমে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে সরকারের যে কয়টি মেগাপ্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে বে টার্মিনাল হচ্ছে সবচেয়ে কম সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য। প্রকল্পের পশ্চাৎসুবিধা বিশেষ করে সারা দেশের সাথে সড়ক, রেল ও নৌ পথের যোগাযোগ একেবারে তৈরি অবস্থায় আছে বলা যায়। ফলে বে টার্মিনালের দ্রুত বাস্তবায়ন দেশের বন্দরকেন্দ্রিক অর্থনীতির গতি ঊর্ধগামী হবে। প্রাণ সঞ্চার হবে সর্বত্র।