গৌরবগাথা-ঐতিহ্য নিয়ে বহমান, চট্টগ্রামের মেজবান

মো. মহসীন »

চট্টগ্রামের রসনা জগতে ‘মেজবান’ অনেক পুরনো চিরায়ত ঐতিহ্যকে লালন করে আসছে এবং চট্টগ্রামের ঐতিহ্যকে বিশেষ গৌরবান্বিত করেছে। মেজবান বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী একটি অনুষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই ঐতিহ্যবাহী মেজবান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে একপ্রকার সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে মিলন, বন্ধনের ক্ষেত্র রচিত হয়ে থাকে। মেজবান এর রুচিসম্মত লোভনীয় সুগন্ধি সমেত সুস্বাদু খাদ্যের সমাহার অধিকাংশ মানুষকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে থাকে। চট্টগ্রামের মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে যেন মিশে আছে এই মেজবান। মেজবান শব্দটি শুনলেই এ অঞ্চলের অনেক মানুষ যেন পাগল প্রায় হয়ে উঠে ।
যতদূরেই হোক, যত টাকাই খরচ হোক তারা মেজবানে অংশগ্রহণ করার জন্য ছুটে যায়। চট্টগ্রামের এই মেজবানি খাবারের জনপ্রিয়তা দেশবিদেশেও বেশ সমাদৃত হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও এই মেজবানের আয়োজন করা হয়ে থাকে ।
মেজবান চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ঐতিহ্য এবং এ ঐতিহ্য চট্টগ্রামে অতি প্রাচীনকাল থেকে অনেক আনন্দমুখর সাড়ম্বর পরিবেশ বজায় রেখে এখনও বহমান। মেজবান সামাজিক মর্যাদাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। সমাজের ধনী গরিব সকলে যার যার সাধ্যমতো তাদের যে কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই মেজবান আয়োজন করে থাকে। চট্টগ্রামে এই মেজবানের উৎপত্তি কখন থেকে শুরু, এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে দীর্ঘকাল ধরে এই মেজবান অনুষ্ঠান চর্চা রীতিমতো অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায় জনআপ্যায়নে এই মেজবান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার রেওয়াজ চালু রয়েছে। মেজবানি খাবারে সুস্বাদু বিভিন্ন আইটেম, যেমনটি হলো, রসালো মসলা সমৃদ্ধ গো মাংস ; হাড়, চর্বি ও সবজি মিশিয়ে বিশেষ সুস্বাদু চনার ডাল , গরুর নলার ঝোল, মাসকলাইর ডাল এবং সিদ্ধ চালের ভাত সবার কাছে মোহনীয় আকর্ষণ সৃষ্টি করে থাকে।
সম্প্রতি হোটেল – রেস্তোরাঁয়ও মেজবানি খাবার বিক্রির বেশ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, আবার রেস্টুরেন্ট থেকে অনলাইন ভিত্তিক বেচাবিক্রিও হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ‘ফুডপ্যান্ডা’ নামক একটি রেস্টুরেন্ট মেজবানি খাবার সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে খুব পরিচিতি লাভ করেছে। চট্টগ্রাম শহরে আরও অনেক রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেগুলো প্রায়শ মেজবানি খাবার বিক্রির জন্য বেশ উল্লেখযোগ্য। যেমন ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ুন’, ‘মেজবান বাড়ি’ এগুলো ছাড়া আরও মেজবানি খাবার বিক্রির নিত্যনতুন রেস্টুরেন্ট চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে।
শীত মৌসুমে মেজবানি খাবারের প্রতি মানুষের বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। শীতে অধিকাংশ মেজবানি খাবারের রেস্টুরেন্টে খুব বেশি ভিড় পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও মেজবানি খাবার বিক্রির রেস্টুরেন্ট রয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ রসনাবিলাসের ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে, আর অতিথি আপ্যায়নে চট্টগ্রামবাসীর বেশ সুনাম রয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী মেজবান ঢাকায় চট্টগ্রাম সমিতি প্রতি বছর ব্যাপক আকারে আয়োজন করে থাকে। তাছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ইসালে সওয়াব ও আত্মার মাগফিরাত কামনা করতে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চট্টগ্রামের বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক চসিক মেয়র প্রয়াত আলহাজ মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষ থেকে সেখানে ব্যাপক আকারে প্রায় ৩০,০০০ হাজার মানুষের জন্য মেজবান আয়োজন করা হয়ে থাকে। তাছাড়া, চট্টগ্রামের মাটিতে শায়িত বহু আউলিয়া আকরামদের ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ওরশ মোবারকেও মেজবানি খাবারের আয়োজন হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু ইতিহাসবিদের মতে, শতবর্ষের পরিক্রমায় মেজবান শব্দটার অর্থ বিশ্লেষণে অনেক পরিবর্তন লক্ষণীয়, বর্তমানে মেজবানের নামটি আপ্যায়ন ক্ষেত্রে বিশেষ বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।
মেজবানে অতিথি উপস্থিতি নিয়ে কোন সীমাবদ্ধতা নেই, অর্থাৎ যত অতিথি মেজবানে আসবে এবং তারা যে পরিমাণ খেতে চাইবে ততটুকু তাদের খাওয়ানোটাই হলো আদর্শ মেজবানের বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতপক্ষে মেজবানি রান্নার মধ্যে রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব ও বিশেষ শৈল্পিকতা, যা মেজবানকে করেছে বিশেষরূপে সমৃদ্ধশালী। গৌরবময় ঐতিহ্যে লালিত এই মেজবান চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে করেছে অনেক সমৃদ্ধ ও মহিমান্বিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক