‘গৃহহীনে গৃহ’ : মুজিববর্ষে শ্রেষ্ঠ উৎসব

সুভাষ দে »

শুধু বিঘেÑদুই, ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।/ বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে’/ কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই’/ চেয়ে দেখো মোর, আছে বড় জোর মরিবার মতো ঠাঁই’।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতায় সামন্ত জমিদারের বাগান করার লোভের কাছে ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষি উপেনকে অসহায়ভাবে তার শেষ সম্বল ভিটেটুকু হারাতে হয়েছে। এভাবে ভূমিহীন হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে অজানার পথে পা বাড়ায় উপেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পে দরিদ্র অসহায় ভাগচাষি গফুরের জীবনের পরিণতি আজও পাঠককে কাঁদায়। অভাব অনটনের জ্বালা আর নিজের প্রিয় মহেশের মৃত্যু, গোÑহত্যার দায়ে জমিদারের কঠোর শাস্তির ভয়ে কন্যা আমিনাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে তার আজন্ম ভিটে ছেড়ে চলে গেলো গফুর টিটাগড়ের কলে। এভাবে ভাগচাষি গফুর, ভূমিদাস গফুর ভিটে হারিয়ে কলের শ্রমিকে পরিণত হলো।
উপেনÑগফুরের এই কাহিনী একশ বছরেরও আগের কিন্তু এত বছর পরও আমাদের দেশে অসংখ্য উপেনÑগফুর ভূমিহীন হচ্ছে। গ্রামের প্রতাপশালীদের লোভ, স্বার্থ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এনজিওÑমহাজনের ঋণ, অসহনীয় দারিদ্র্য তাদের শহর গঞ্জে জীবিকার সন্ধানে ছুটতে বাধ্য করেছে অথবা ভিক্ষাবৃত্তি নিতে তারা বাধ্য হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য যে ঠিকানাটি প্রয়োজন তা থেকে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বঞ্চিত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এই অবস্থা চলে আসছে। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনে, ভূমিহীন, ভিটেহারা এসব মানুষের কাহিনী সাহিত্য, শিল্প, চলচ্চিত্রে এসেছে। হতশ্রী জীবনের উন্মোচন ঘটেছে করুণভাবে শিল্পে, সাহিত্যে।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপ্ন ছিল, জনগণের আকাক্সক্ষা ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই ৫টি মানুষের জীবনধারণের মৌলিক উপাদান, এই এসব প্রাপ্তি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও সুযোগ, রাষ্ট্রকে এসব সুযোগ ও অধিকার প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বিগত ৫ দশকে দারিদ্র্য কমেছে, অন্ন ও বস্ত্রের অভাব মোটামুটি দূর হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগও সকলের জন্য সম্প্রসারিত হয়েছে কিন্তু বাসস্থানের সুবিধা গরিব মানুষের জন্য সর্বাংশে করা যায়নি। দেশে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অনেক। এই গৃহহীন মানুষদের ঘর দেবার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে গৃহহীনে গৃহ দেবার কাজটি শুরু করেছেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; গত শনিবার তিনি এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গৃহ ও জমি প্রদানের কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন। এই কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের ৪৯২টি উপজেলায় ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারকে গৃহ ও জমি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণ করে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
গৃহপ্রদান কর্মসূচি উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে, ‘মুজিব বর্ষের লক্ষ্য যাতে প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। দেশের ভূমিহীন গৃহহীন মানুষকে ঘর দিতে পারার চেয়ে বড় কোনো উৎসব আর কিছুই হতে পারে না’। (প্রথম আলো ২৪ জানুয়ারি ২০২১) ভূমিহীন ও গৃহহীনদের যে বাড়িগুলি দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে তা স্বামী স্ত্রী দুজনের নামে রেজিস্ট্রি দলিল করা হয়েছে। দলিলে তাদের দুজনের নাম ও ছবি থাকবে। প্রতিটি পরিবারকে কবুলিয়ত দলিল, নামজারি ও গৃহ প্রদানের সনদ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে অব্যবহৃত খাস জমির ওপর এই ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। দুই শতক জমিতে প্রতিটি দুই রুমের সেমিপাকা টিনশেড বাড়িতে রান্নাঘর, টয়লেট, বারান্দা, বিদ্যুৎ ও পানির সুবিধা রয়েছে। ঘরের পাশে আরো ২ শতক জায়গা দেওয়া হয়েছে প্রতিটি পরিবারকে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে আরো ১ লাখ এ ধরণের বাড়ির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। সমগ্র দেশে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারকে ঘর করে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। ভূমিহীনÑগৃহহীনদের এই তালিকা প্রণয়নের যুক্ত রয়েছে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সারা দেশের ছিন্নমূল, দিনমজুর, বেদে, হরিজন, বিধবা, ভিক্ষুক, ক্ষুদ্র নৃÑগোষ্ঠীসহ দলিত ও প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে এই তালিকা করা হয়েছে। আশ্রয়ন, গৃহায়ন, গুচ্ছগ্রাম ও পুনর্বাসন প্রকল্পের অধীনে এসব ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে এ ঘর পাচ্ছেন উপকারভোগীরা।
নানাকারণে আমাদের দেশের মানুষ ভূমিহীনÑগৃহহীন হয়ে দিন কাটাচ্ছে, এরমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত নদী ও সমুদ্র উপকূলীয় ভাঙন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ ভিটেহারা হচ্ছে। সহায়সম্পদ, জায়গাÑজমি হারাচ্ছে, দারিদ্র্যের কবলে পড়ছে। অসুখÑবিসুখ, মেয়ের বিয়ে, মহাজনÑএনজিওর ঋণ পরিশোধ এসব কারণেও অনেকে শেষ সম্বল জায়গাÑজমি, ভিটেমাটি বিক্রি করে শহরÑগঞ্জে চলে যাচ্ছে বেঁচে থাকার আশায়। ফলে শহরের ওপর চাপ বাড়ছে। পরিবেশগত নানা সংকট, সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ঘরবাড়ি থাকলে মানুষ তার আশেÑপাশে জীবিকার সংস্থান করতে পারে। সরকারের দেওয়া এসব তাদের মাথাগোঁজার ঠাঁই হলো, এখন এর কাছাকাছি কর্মসংস্থান, জীবিকার ব্যবস্থা করে দিতে সরকারকে তৎপর হতে হবে। এদের সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনিতে যুক্ত করতে হবে। ঘরগুলি গ্রোথ সেন্টারের কাছে হওয়ায় সন্তানদের লেখাপড়ায় সুযোগ হবে। কাজ করে দিনযাপনের মতো পরিবেশও সৃষ্টি হবে। এদের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মোট কথা, এদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে বেসরকারি সংগঠন ও স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো কর্মসূচি নিতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে, বিশেষত নদীভাঙন ও বন্যারোধে বিস্তারিত কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। নতুবা প্রতিবছর নতুন করে মানুষ গৃহহীন হবে, দারিদ্র্য বাড়বে।
একটি কল্যাণমুখি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে বৈষম্যের অবসান জরুরি। করোনার কালে মানুষের দারিদ্র্য বেড়েছে। নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনমানে ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। সকল নাগরিক যাতে সমতাপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারী হতে পারে সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সাজাতে হবে। গ্রামের কৃষক, চাষি যাতে তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়, যেটি তার জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য, তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সরকারিÑ বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা দেশের উন্নয়নের কথা বললেও ব্যাপক বৈষম্যের কথা তারা স্বীকার করছেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে বৈষম্য কমে আসবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবর্ষে তথা মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে সরকারের নেওয়া ভূমিহীনÑগৃহহীন জনগণের জন্য গৃহদান কর্মসূচি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও মানবিক কাজ। এটি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় বলে আমি মনে করি। এটি সামাজিক সহায়তায় বড়ো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডি অর্জনের পথে এই গৃহায়ন কর্মসূচি একটি মাইলফলক বলা যেতে পারে। দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর ও কল্যাণকামী সমাজ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে এবং সংবিধান অনুসারে জনগণের সকল মৌলিক অধিকার প্রাপ্যতা বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে।
প্রায় ৭০ হাজার পরিবারের জন্য নিরাপদ বাসস্থান নির্মাণের কাজটি অল্পসময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীন অন্যান্য পরিবারগুলির জন্য বাসস্থান নির্মাণ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে বলে আশা করি। পরিবারগুলির কর্মক্ষম মানুষের উৎপাদনশীলতা সমাজ ও জাতির উন্নতিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। গত শনিবার গৃহদান কর্মসূচির উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশে একজন মানুষ ও যাতে গৃহহীন না থাকে, সেজন্য দেশের গৃহহীনদের নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করে দেওয়া হবে। আশা করি, সরকার জনসাধারণের অন্যান্য মৌলিক অধিকার প্রদানে পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি নেবে। এভাবেই দেশ এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক