‘গণপ্রকৌশল’ দিবস ও ‘নীল অর্থনীতি’ প্রসঙ্গে

মোতাহার হোসেন »

পেশাজীবী সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) এর প্রতিষ্ঠা ৫০ বছর আগে। জাতির উন্নয়ন,কল্যাণকে অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব দিয়েই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮ নভেম্বর, ২০২০ আইডিইবি’র সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নীল অর্থনীতি এনে দেবে সমৃদ্ধি’। তাদের এই প্রতিপাদ্য প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের গৃহীত‘ শত বছরের ব-দ্বীপ’পরিকল্পনা (ডেল্টা প্ল্যান) এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমান সরকার ব্লু ইকোনোমি বা নদীমাতৃক বাংলাদেশের পানি ও সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতেই ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে কাজ করছে। আইডিইবি তাদের প্রতিষ্ঠা দিবসকে,‘গণপ্রকৌশল দিবস’হিসেবে পালন করে আসছে। সহজ ভাষায় গণপ্রকৌশল দিবসের ইংরেজি করলে দাঁড়ায়‘ পিপলস ইঞ্জিনিয়ারিং ডে’। এর বাংলা অর্থ,‘জনগণের জন্য প্রকৌশল সেবা’। এর যথার্থতা বিগত ৫০ বছরে জনগণ কেন্দ্রীক,জনকল্যাণ ও জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আইডিইবি’র কর্মকা-ে এর স্বাক্ষর রয়েছে।
আইডিইবি‘নীল অর্থনীতি এনে দেবে সমৃদ্ধি’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সুবর্ণজয়ন্তী ও গণপ্রকৌশল দিবস উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এসব কর্মসূচি।
৮ নভেম্বর ২০২০ গণপ্রকৌশল দিবস ও সুবর্ণজয়ন্তীর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে চলবে ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত।
আইডিইবি’র প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারে বঙ্গবন্ধু’র শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়ন, প্রযুক্তিমনস্ক জাতি গঠনে রাজনীতিতে প্রযুক্তিভাবনা যুক্তকরণ, দেশের নদ নদী রক্ষা, পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, কৃষি জমি রক্ষা এবং পরিকল্পিত নগর ও গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়সহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আইডিইবি’র সময়োপযোগী আহ্বানসমূহ জনগণকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করেছে। আইডিইবি’র ৫০ বছরের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এসব প্রযুক্তিনির্ভর আহ্বান অতীত, বর্তমান, অনাগত প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে বলে তাদের বিশ্বাস।
বর্তমান বিশ্বে ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি বা সমুদ্র অর্থনীতিকে সম্ভাবনাময় বিকল্প অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্লু ইকোনমির আধুনিক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সমুদ্রে যে পানি আছে এবং এর তলদেশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেই সব সম্পদকে যদি আমরা টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করি তবে তাকে ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি বলে। ভারত মহাসাগরের ব-দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য ব্লু ইকোনমি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বঙ্গবন্ধু’র পথনির্দেশনায় আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ মিটিয়ে বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব উত্তরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব ও অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান, এই সম্পদের প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্র তলদেশে রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস সহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন ক্ষেত্রে পরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সমুদ্র জয়ের ফলে বঙ্গোপসাগরে ভারতের হাতে থাকা ১০ টি গ্যাস ব্লকের মধ্যে ৮ টি এবং মিয়ানমারের ১৮টির মধ্যে ১৩ টির মালিকানা বাংলাদেশ পেয়েছে। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস পাওয়া সম্ভব। তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশের ১৩টি জায়গায় সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান বালি, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম রয়েছে। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট। অগভীরে জমে আছে ‘ক্লে’। যা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। বঙ্গোপসাগরের নিচে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। যা আগামী দিনের জ্বালানি-রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৯০০ কোটি। মানুষের খাবার যোগান শুধুমাত্র ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সম্ভব হবে না। গবেষকদের ধারণা, বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগানের জন্য সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। বর্তমান বিশ্বে ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান আসে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু থেকে। ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ন্যূনতম ১.৭৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালুর সমাহার রয়েছে দেশের সমুদ্র উপকূলে। এখানে মোট ১৭ প্রকারের খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, লিউকোক্সিন, কিয়ানাইট, মোনাজাইট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষমতা রাখে। বিশ্বে ব্যবহৃত শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ম্যাগনেশিয়াম সামুদ্রিক পানি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরিও সম্ভব। সমুদ্র ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সাগর থেকে প্রাপ্ত বায়ুু, তরঙ্গ ঢেউ, জোয়ার-ভাটা, জৈব-তাপীয় পরিবর্তন এবং লবণাক্ততার মাত্রা প্রভৃতির মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তির জোগান পাওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। বিশেষজ্ঞদের অভিমত ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ সমুদ্র অর্থনীতি থেকে আসবে, এজন্য প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। মূলত সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ধারণা থেকে আইডিইবি’র সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রতিপাদ্য “নীল অর্থনীতি এনে দেবে সমৃদ্ধি”। এর শতভাগ বাস্তবায়নে সরকার,আইডিইবিসহ সকল পেশাজীবী এবং সংশ্লিষ্ট মহল নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ অবশ্যই সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম