কেন্দ্রের ভেতরে ফাঁকা বাইরে জটলা

সরেজমিন ভোটচিত্র
জাল ভোটের সুযোগ ছিল না
কেন্দ্রগুলোতে ছিল না বিএনপির এজেন্ট

ভূঁইয়া নজরুল/রুমন ভট্টাচার্য/মোহাম্মদ কাইয়ুম :
ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১১টা। ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর সমর্থিত প্রার্থী শৈবাল দাস সুমনের সাথে সংঘর্ষ চলছে। এসময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ ও এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে।
বাহিরে যখন এই চিত্র, ভেতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। কেন্দ্রের ভেতরে কোনো মানুষজন নেই। প্রায় ফাঁকা। বুথগুলোতে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসারগণ বসে আছেন ভোটারের অপেক্ষায়।
গতকাল দিনভর নগরীর কেন্দ্রগুলোতে প্রায় এমন চিত্রই দেখা গেছে। তবে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
ডা. খাস্তগীর স্কুল কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমার কেন্দ্রে সকাল ১১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ১০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। ভোটাররা ধীরে ধীরে কেন্দ্রে আসছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিললেই তারা ভোট দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।’
ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলছে না এমন কোনো ঘটনা কি আছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাতের হাতে মেহেদি থাকে কিংবা হাতের রেখা মুছে গেছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। কিন্তু তখন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে থাকা ক্ষমতার (এক শতাংশ ভোট প্রদান করা যাবে) মাধ্যমে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
তবে, কেন্দ্রের বাইরে জটলা দেখা যায়। অপরদিকে দুপুর একটায় সরকারি কমার্স কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় বাইরে পুলিশের সশস্ত্র অবস্থান। একটু আগে কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশ ফাঁকা গুলিও ছুঁড়েছে।

 

কেন্দ্রের দুই নম্বর বুথে ৩৮৭টি ভোটের মধ্যে কাস্ট হয়েছে ৩৬টি ভোট। ৫ নম্বর বুথে ৩৮৭টি ভোটের মধ্যে কাস্ট হয়েছে ৬১টি ভোট এবং ১ নম্বর বুথে ৪০৪টি ভোটের মধ্যে কাস্ট হয়েছে ৫১টি।
দুপুর ২টায় উত্তর কাট্টলী জয়তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গিয়ে দেখা গেছে, বাহিরে মানুষের জটলা। ভেতরে ভোটারের উপস্থিতি কম। কেন্দ্রের দুই নম্বর বুথে ৩৮৭ ভোটের মধ্যে জমা পড়েছে ৫৭টি। অপরদিকে এক নম্বর বুথে ৩৮৭ ভোটের মধ্যে ৭৫ ভোট জমা পড়েছে।
উত্তর পাহাড়তলী কৈবল্যধাম বিশ্বকলোনির হাউজিং স্টেট বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিকাল তিনটায় গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরে পুলিশের লাঠিচার্জ চলছে। অপরদিকে ভেতরে ভোটের হার খুব কম। ৮ নম্বর বুথে ৪১৬টি ভোটের মধ্যে জমা পড়েছে ৬৮টি। ৬ নম্বর বুথে ৪১৮ ভোটের মধ্যে জমা পড়েছে ৪০টি ভোট।
জাল ভোটের সুযোগ ছিল না
প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হয় এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ইভিএমের একটি সুবিধা হলো একজনের ভোট অপরজনে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর এতে জাল ভোট পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেন্দ্রগুলোতে কাউন্সিলর সমর্থিত প্রার্থীরা যার যার মতো অবস্থান নিলেও তাদের পক্ষে ভোট দেয়া সম্ভব হয়নি।

 

এ বিষয়ে আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ কেন্দ্রের এক নম্বর বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার গোফরান উদ্দিন টিটু বলেন, ইভিএমে একজনের ভোট আরেকজনের দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর একারণে ভোট গ্রহণের হার খুব কম। ভোটাররা কেন্দ্রে এলেই সহজে ভোট দিতে পারছে। ইভিএমে জাল ভোটের দিন শেষ।
ভোটারদের দীর্ঘ লাইন ছিল না
অন্যান্য ভোটে কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন থাকলেও এবার এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে। এবার কেন্দ্রগুলোর বুথ প্রায় ফাঁকা ছিল, কেন্দ্রের বাইরেও ভোটারদের লাইন ছিল না। সরকারি অফিস আদালত খোলা থাকা এবং আতঙ্কের কারণে অনেকে ভোট কেন্দ্রে যাননি। সকাল ৯টায় নগরীর বিএড কলেজ গিয়ে দেখা যায়, ভোট কেন্দ্রের বাইরে মানুষের জটলা। ভিতরেও প্রায় একই চিত্র। তবে এ সময় ভোটারদের লাইন কোথাও চোখে পড়েনি। প্রায় সব ভোট কেন্দ্রই ছিল মোটামুটি ফাঁকা। ভোটের দায়িত্বে থাকাদের অনেকটা অলস সময় কাটাতে দেখা যায়। এছাড়া ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে এনআইডি দেখার কথা থাকলেও সে চিত্রও চোখে পড়েনি।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে র‌্যাবের একটি দল এসে ভিতরে ও বাইরে বহিরাগত অনেককেই বাইরে বের করে দেন। তবে যাওয়ার ৫ মিনিট পর আবারো সেই একই চিত্র চোখে পড়ে। ৯টা ৪০ মিনিটে ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। প্রায় ১৫-২০ মিনিট কক্ষ খোঁজার পর তিনি ভোট দেন। এর আগে তিনি ২০৮ নম্বর কক্ষের একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে বিএনপির এজেন্ট না থাকার কারণ জানতে চান। পরে তিনি ৫ নম্বর কক্ষে এসে নিজের ভোট দেন।
সকাল ১১টায় বাকলিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের বাইরে দেখা যায় মানুষের জটলা। স্কুলের ভিতরে ঢুকতে গেলে এই প্রতিবেদককে বাঁধা দেয় এক পুলিশ সদস্য পরে তাকে পরিচয় দিলে ভেতরে ঢুকতে দেন। স্কুলের নীচ তলা ও দ্বিতীয় তলা প্রায় ৩-৪টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি কেন্দ্রে ১-২ জন ভোটার। ভোটারদের কোনো লাইন ও জটলা নেই।
এরপর বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাইরে ও ভিতরে তরুণ-যুবকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। তবে ভোটারদের চেয়ে কর্মী ও সমর্থকের সংখ্যাই ছিলই বেশি। পশ্চিম বাকলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভিতরে ফাঁকা থাকলেও গেটের সামনে মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি।
সকাল সাড়ে ১১টায় কাতালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ও কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন মহিলা কলেজের ভিতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল বেশি। তবে বাইরে মানুষের জটলা দেখা গেলেও ভোট কেন্দ্রের ভিতর ছিল ফাঁকা। কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন মহিলা কলেজের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে একজন ভোটারের সাথে এজেন্টের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতে দেখা যায়। এছাড়া একজন ভোটার ভোট কক্ষের গোপন বুথে গেলে সেখানে তার পিছনে আরেকজন গিয়ে ভোট কোথায় দেবেন এমনটা বলে দিচ্ছেন। বের হয়ে ওই ভোটার বোতাম টিপে দেওয়ার অভিযোগ করেন।
এছাড়া কদম মোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয়, কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, গুলজার বেগম সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়, এখলাছুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডা. খাস্তগীর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি কেন্দ্রেও ছিল প্রায় একই চিত্র।
প্রতিটি কেন্দ্রেই সকাল থেকে ভোটারদের উপস্থিতি মোটামুটি হলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে একেবারেই কমে যায়। দুপুর ২টার মধ্যেই প্রায় সব কেন্দ্রই ফাঁকা হয়ে পড়ে। অনেক কেন্দ্রে গিয়ে বাইরের গেট বন্ধ পাওয়া যায়। ভিতরে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান।
কেন্দ্রগুলোতে ছিল না বিএনপির এজেন্ট
১০টা ৪০ মিনিটে বাকলিয়া সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে শারমিন আক্তার নামে একজন বিএনপির এজেন্ট এসে সাংবাদিকদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেন। এছাড়া একই অভিযোগ করেন একই কেন্দ্রের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. সোয়েব খালেদের এজেন্ট আকতার হোসেন।
পরে এজেন্ট শারমিন আক্তারের সাথে তর্কে জড়ান কাউন্সিলর প্রার্থী সোয়েব খালেদ। এসময় বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত এগিয়ে আসেন সমস্যার সমাধানে। সমাধান শেষে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৮-১০ জন বিএনপির মহিলা এজেন্ট তার কাছে অভিযোগ জানালে তিনি বিষয়টি ওই কেন্দ্রে উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোনে অবহিত করলে তিনি আসেন এবং ডা. শাহাদাত ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে এজেন্টদের তালিকার একটি কপি দিলে এজেন্টরা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে যান।
সকাল ১০টায় বাকলিয়া সরকারি কলেজ টিনসেড কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের ভিতরে কোন ভোটারদের উপস্থিতি না থাকলেও কেন্দ্রের ভেতরে বহিরাগতদের জটলায় ভেতরে ভোটাররা প্রবেশ বাঁধার সৃষ্টি হয়। এছাড়া কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পরিচয়পত্র দেখার কথা থাকলেও তা না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জটলা বেঁধে আড্ডায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। কেন্দ্রের মধ্যে মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর কোন এজেন্টের উপস্থিতি ছিল না। এছাড়া দল বেঁধে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর সমর্থকের প্রবেশ করতে দেখা যায়।

দুপুর ২টা ১৫মিনিটের দিকে সরকারি ন্যাশনাল প্রাথমিক বিদ্যালয় মহিলা কেন্দ্রে দেখা যায়, ভোটার না থাকায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা অলস বসে সময় কাটাচ্ছে। তখন ওই কেন্দ্রে দুই হাজার ৩৭৭জন মহিলা ভোটারদের মধ্যে মাত্র ৯.৭৬ শতাংশ ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। কেন্দ্রের ভেতরে কোন ভোটারের উপস্থিতি না থাকলেও কেন্দ্রের সীমানার ভেতরে ও বাইরে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের দুপুরের খাবার গ্রহণ থেকে শুরু করে আড্ডায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। বহিরাগতদের কেন্দ্র থেকে বের করা দূরের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনে কোন আগ্রহই দেখা যায়নি।
দুপুর ২টা ৩০ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মিউনিসিপ্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বুথের মধ্যে ভোটারের উপস্থিতি না থাকলেও বুথের বাইরে ও কেন্দ্রের সীমানার মধ্যে বহিরাগতদের জটলা হয়ে থাকতে দেখা যায়। এছাড়া মাঝে মধ্যে কয়েকজন পুরুষ ভোটার ভোট দিতে এলেও মহিলা বুথে ভোটারের উপস্থিতিও ছিল না। ওই কেন্দ্রে ৪৫৫ জন মহিলা ভোটার থাকলেও দুপুর ২টা ৩৫ পর্যন্ত মাত্র ৬২ জন ভোটার ভোট প্রদান করে।
বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ কম থাকলেও ভিন্ন চিত্র দেখা যায় পাথরঘাটা জে ডি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, বিকাল ৩টার দিকে ওই কেন্দ্রে ১৪৬০ জন ভোটারের বিপরীতে ৫৪৭ জন ভোটার ভোট প্রদান করে। এছাড়া কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছিল না।
উল্লেখ্য, গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয়। নির্বাচনে সাত জন মেয়র, ১৭৩ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ৫৭ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর লড়াই করে।