কীর্তিমান পুথি গবেষক ইসহাক চৌধুরী

রশীদ এনাম :

“চলে যাওযা মানে প্রস্থান নয়-বিচ্ছেদ নয়, চলে যাওয়া মানে বন্ধন ছিন্ন করা, আর্দ্র রজনী চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে, আমার না-থাকা জুড়ে। জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে”Ñ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর চরণগুলি বাস্তব জীবনের কথা বলে। সত্যি আমাদের জীবনটা সমুদ্রের পানে উড়ে যাওয়া গাংচিলের মতো, কখনও বা ফিনিক্স পাখির মতো। এলো বুঝি গেলো। মাঝখানে শুধু ক্ষণিক সময়টুকু। মানুষ  বেঁচে থাকে তাঁর কর্মে, সাধনায়, অনুশীলন, সৃজনশীলতা ও ভালো কাজের গুণে। বাতিঘরের প্রদীপ যেমন আলো ছড়িয়ে চারিদিকে আলোকিত করে ঠিক  একটা সময় নিভে যায়। প্রদীপের মতো নিভে যাওয়া এক জ্বলন্ত শিখা পুথি গবেষক ইসহাক চৌধুরী। যার সৃষ্টি কর্ম জীয়নকাঠির মতো সফল ব্যক্তিদের মাঝে আলো ছড়াতে নিজেকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রেখেছিলেন।

ইসহাক চৌধুরী ৩০ জুন ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ -লাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পুঁথিগবেষক ও সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী, মাতা ছবিলা খাতুন। পিতা আবদুস সাত্তার চৌধুরী পেশায় একজন শিক্ষক। ১৯৮২ সালে তিনি মালেকা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক।

পটিয়া লড়িহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখার হাতেখড়ি। হাবিলাসদ্বীপ স্কুল থেকে এসএসসি, সালেহ নুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে বিবলিওগ্রাফার হিসেবে যোগদান করেন এবং বিশ^বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে পুথি গবেষণার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাংলা বিভাগে অধ্যয়নের সময় লেখাপড়া অনেকটা ইতি টানলেও বই পোকা হয়ে ইতিহাস ও লোকসাহিত্যর অলিতে-গলিতে চষে বেড়িয়েছেন। লোকসাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ইসহাক চৌধুরীকে আমরা দেখি একজন বৌদ্ধিক আলোকিত ভালো মানুষ হিসেবে ।

ইসহাক চৌধুরী মূলত পিতার কাছে পুথি পাঠের হাতেখড়ি। পিতার অনুপ্রেরণায় নিজের মেধা ও মননে পুথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণে উৎসাহিত হন। তিনি একাধারে বিবলিওগ্রাফার, পুথি গবেষক, লেখক ও মালঞ্চ সংগঠক।  পুথি নিয়ে জীবনের সাথে খেলা করা ছিল তাঁর নেশা। সংগ্রহ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে চাকুরিরত অবস্থায় নিয়মিত লিখেছেন চট্টগ্রামের জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। আশির দশকে লেখক ও গবেষক শামসুল হক কর্তৃক সম্পাদিত পটিয়া থেকে প্রকাশিত মাসিক অভয়বাণী পত্রিকার মাধ্যেমে লেখালেখি শুরু করেন। দেশবরেণ্য পুঁথি সংগ্রাহক পুথির যাদুকর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কাছের আত্মীয় এবং উত্তরসূরীও বটে। আবদুস সাত্তার চৌধুরী ইন্তেকালের পরে ইসহাক চৌধুরী পুথির সাগরে সাঁতরে বেড়িয়েছেন। বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও জনপদে পুথি সংগ্রহের জন্য সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে বিচরণ করেছেন। ইসহাক চৌধুরী ছিলেন লোকসাহিত্যের কিংবদন্তিÑঅনেকটা জীবন্ত অভিধানও বলা যায়। পিতা ও নিজের সংগৃহীত পুথি নিয়ে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সংগ্রহশালা।

সংগ্রহশালায় পুঁথি বই ছাড়াও ব্রিটিশ আমলে পটিয়া কাগজীপাড়ায় হাতে তৈরি কাগজ পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রেখেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মকালীন সময়ে ইসহাক চৌধুরীকে পুঁথি গবেষণার কাজে উৎসাহ দিয়েছেন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুলতান আহমেদ এবং অধ্যাপক ডক্টর মনিরুজ্জামান স্যার।

একদা পটিয়ায় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিমের স্মরণসভায় ডক্টর মনিরুজ্জামান স্যার ইসহাক চৌধুরীকে নিয়ে মন্তব্য করে বলেছিলেন, আমি ডক্টর অধ্যাপক হতে পারি কিন্তু আমার চেয়েও অনেক বড় ডক্টর হলো আমার ইসহাক চৌধুরী। তাঁর পুথি গবেষণা, লোক সাহিত্য ও ইতিহাস বিষয়ে পা-িত্য আমাকে মুগ্ধ করে। ইসহাক চৌধুরীর পুথিগবেষণায় পা-িত্য আজও আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পুথি সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে সর্বশেষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন ইসহাক চৌধুরী।

পুথি গবেষণা ও লোকসাহিত্যের জন্য চট্টগ্রাম একাডেমি পদক, চট্টগ্রাম শিল্পকলা সম্মাননা, আবদুল হক চৌধুরী পদক, একুশে বইমেলা পরিষদ চট্টগ্রাম কর্তৃক সম্মাননা, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্মাননা, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম পদক, পটিয়া মালঞ্চ পদকসহ আরো বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লোক সাহিত্য কর্ম ও গবেষণা কাজের জন্য স্বীকৃতি ও বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন।

পুথিগবেষক ইসহাক চৌধুরী নিজ গ্রামে বড় হয়েছেন।

গ্রামীণ জীবনযাপন ছিল তাঁর পছন্দের। কখনও শহরে থাকতেন না। বেশ মিষ্টভাষীও ছিলেন।

খুব সহজে মানুষকে আপন করে নিতেন। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতেন।

খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। বেশ ধার্মিকও ছিলেন। এতিমখানার ছাত্রদের খাওয়াতে পছন্দ করতেন।

আতিথেয়তা, আপ্যায়ন এবং প্রিয়জনদের দাওয়াত করে খাওয়ানো ছিল তাঁর বড় গুণ। বিশ^বিদ্যালয় এবং বাংলা একাডেমি থেকে পটিয়ায় তাঁর সংগ্রহশালা পরিদর্শনে গেলে সবাইকে  সাদরে দাওয়াত করতেন।

বই পড়তে বেশ পছন্দ করতেন। কখনও পরিবারের সদস্যদের সাথে অভিমান করলে তিনি বই নিয়ে বসে যেতেন।

বই ছিল ওনার কাছে মনের দাওয়াইর মতো।