করোনা ভাইরাসের সাথে মানবজাতির লড়াই কার্যকরী প্রতিষেধকের প্রত্যাশা

রতন কুমার তুরী »

করোনা মহামারির শুরু থেকেই করোনার সাথে যুদ্ধ করে চলেছে পৃথিবীর মানুষ। এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে পৃথিবীময়। এই বিরল ভাইরাসটির কোনো প্রতিষেধক নেই জেনেও (ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত) মানুষ যেভাবে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি বেশ কয়েকবার এসেছে কিন্তু এবারের পরিস্থিতি মানবজাতিকে এক ভিন্ন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা মানুষের জীবনাচরণের পদ্ধতিই পরিবর্তন করে ফেলেছে এই ভাইরাস।
এই পরিস্থিতি আসার আগে বিশ্বদূষণরোধে বারবার সতর্ক করা হলেও মানুষ এতে কর্ণপাত করেনি এমনকি নিজেদের শারীরিক সুস্থতার জন্য চোখ, মুখ ঢেকে রাখতে বলা হলেও তা তারা থোড়াই কেয়ার করেছে। এরফলে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এসব রোগাক্রান্তের বেশিরভাগই হয়েছে পৃথিবীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের কারণে।
প্রকৃতির সাথে পৃথিবীর মানুষের এমন বৈরি আচরণের জন্য প্রকৃতিও তার বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রকৃতি কখনও ঘূর্ণিঝড়, কখনও বন্যা, আবার কখনওবা সুনামি দিয়ে মানুষের বিরুদ্ধে গেছে।
বর্তমান করোনাকালটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত চীনের উহান অঞ্চল থেকে শুরু হলেও তা ক্রমান্বয়ে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে এখন স্থিতি অবস্থায় আছে।
পৃথিবীর মানুষ এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে এখনও প্রতিরোধের রাস্তাতেই আছে। এই ভাইরাসের উৎপত্তির বেলা ও প্রকৃতির অবোধ প্রাণির হত্যা করে তা খাদ্য হিসেবে মানুষের শরীরে যাওয়ার পর এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন যদিও এ মতটি নিয়ে এখনও মতান্তর রয়েছে তবে এ পর্যন্ত এই ভাইরাসের উৎপত্তি বন্যপ্রাণি এবং সামূদ্রিক মাছ থেকেই ছড়িয়েছে বলে সর্বাধিক মতবাদ রয়েছে। এই ভাইরাসটি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে আজ নয় মাসেরও অধিক সময় পেরিয়ে গেছে। মানুষ এই ভাইরাসের কারণে তাদের জীবনপ্রণালীরও পরিবর্তন করে ফেলেছে ।
এখন মানুষ অনেকটা বুঝে গেছে এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে কী কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে। এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে যে এর বিরুদ্ধে সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনেই যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে এই বিষয়টি ইতিমধ্যে পৃথিবীর সব মানুষের মনে গেঁথে গেছে ফলে মানুষও এই ভাইরাসের সাথে আস্তে আস্তে নিজেদের খাপ খাওয়াতে শুরু করেছে।
আর তাই ভাইরাসটি সংক্রমণের প্রথমদিকে মানুষ ঘর থেকে বের না হলেও এখন তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘর থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করেছে। জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম এক সাথেই চলছে।
ইতিমধ্যে অনেক দেশ এই ভাইরাসটিকে নিজেদের আয়ত্তে এনে এর সংক্রমণ কমাতে সফল হয়েছে এবং এই ভাইরাসের মৃত্যুর উচ্চহার ঠেকাতে সফল হয়েছে। তবে এই ভাইরাসের সম্পূর্ণ অগ্রযাত্রা রোধ করতে যে জিনিসটির সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেই বহু আকাক্সিক্ষত প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার না হওয়ায় পৃথিবীর অনুজীব বিজ্ঞানীরা দুশ্চিন্তা এবং চাপে রয়েছেন, তারা অবশ্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এই ভাইরাসটির দ্রুত প্রতিষেধক বাজারে এনে মানুষের জীবন বাঁচাতে। এর পূর্বেও অবশ্য পৃথিবীতে যতগুলো মহামারি এসেছে সেসব মহামারিও পৃথিবীতে বেশ কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল, শুধুমাত্র প্রতিষেধক আবিষ্কারের বিলম্বের কারণে প্রতিটি বিপজ্জনক রোগ মহামারির প্রতিষেধক ক্রমান্বয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে।
অনেক দেশই এই ভাইরাসের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন ট্রায়াল দিয়েছে এবং কিছু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানও এর প্রতিষেধকের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
আশা করা যায় এসব অক্লান্ত পরিশ্রমী অনুজীব বিজ্ঞানীদের বদৌলতে আমরা অচিরেই করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক পেয়ে যাবো। তবে প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষের উচিত হবে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে জীবন যাপন করা কারণ ইতিমধ্যে এই ভাইরাসটি যত সংখ্যক মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন না করলে প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত আরো অনেক মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়বে এবং এতে অনেক মানুষেরই জীবন অনিরাপদ হয়ে ওঠতে পারে। আমরা যেহেতু ভাইরাসটির লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায় ইতিমধ্যে জেনে গেছি সেহেতু আমাদের উচিত হবে এর বাইরে এক পাও না দেয়া।
প্রতিদিন করোনা প্রতিরোধী জীবনব্যবস্থায় জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। স্বাস্থ্যবিধি পালন বিষয়ে নিজে সতর্ক হওয়া এবং অপরকে সতর্ক করা। কর্মস্থলে কিংবা যে কোনো কাজে বের হলে মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার করোনা বিষয়ক নির্দেশনাবলি মেনে চলা।
আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে করোনা সমস্যা শুধু আমাদের একার নয় এটা পুরো বিশ্বের সমস্যা তাই এই সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। পৃথিবীর মানুষ করোনা মোকাবেলায় যে সকল সফল পদ্ধতি ব্যবহার করছে সেদিকে লক্ষ রেখেই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
আমাদের দেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ ফলে এই দেশে করোনার মত ছোঁয়াচে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা একটু কঠিনই বলা চলে তারপরও বিগত দিনগুলোতে আমাদের সরকার এবং জনগণ এই ভাইরাসটির সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে টিকে আছে
অবশ্য এরই মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেলেছে এবং তা ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে। সফল ট্রায়াল শেষে এই টিকা দ্রুতই বাজারে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাশিয়া অবশ্য ভ্যাকসিনটি বাজারজাত করার জন্য ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে, এখন তারা বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবীদের শরীরে তা প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আশা করা যায় রাশিয়ার এই ভ্যাকসিনটি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাজারে আসবে। এই ভ্যাকসিনটি বাজারে আসার পর মানুষের দেহে প্রয়োগ করলেই বোঝা যাবে এর কার্যকারিতা কতোদূর। তবে আমরা আশা করতে পারি করোনা ভাইরাসের দিন দ্রুত শেষ হতে চলেছে। পৃথিবী তার স্বরূপে ফিরে আসবে সহসাই এমন প্রত্যাশা সকলের।
করোনা ভাইরাসের টিকা সংগ্রহের ব্যাপারে বাংলাদেশ টিকার ট্রায়ালেররত দেশগুলির সাথে যোগাযোগ রাখছে এবং এই টিকা সংগ্রহে ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘেরর ৭৫তম অধিবেশনে বিশ্বের সকল দেশ সময়মতো যাতে এক সঙ্গে টিকা পায় তা নিশ্চিত করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এই আহ্বানের মূল কথা ছিলো ‘সকল জাতির সুরক্ষা এক সঙ্গে’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে এই মর্মে যে করোনায় বিশ্বে ২০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হতে পারে। ইতিমধ্যে মৃত্যু ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার কথাও বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে এবং সতর্কতার বাণী ও দেশে দেশে উচ্চারিত হচ্ছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শীতকালে করোনার সংক্রমণ বাড়াতে পারে এমন আশঙ্কা করে সকলকে সেভাবে প্রতিরোধ প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এ জন্য আমাদের স্বাস্থ্যখাতে যে সকল অব্যবস্থাপনা দুর্নীতি, অনিয়ম, ঢিলেমি দেখা গেছে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক