করোনা ঠেকাতে হলে বদলাতে হবে অভ্যাস

চট্টগ্রামে প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন : বিএমএ নেতা

নাকে হাত দেওয়া ও মুখোমুখি কথা বলা বন্ধ করতে পারলে করোনা মোকাবেলা সম্ভব : জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক

শুভ্রজিৎ বড়–য়া :

নভেল করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে কঠিন সমস্যা হলো সামাজিক সংক্রমণ। আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেরই কোন ধরনের উপসর্গ না থাকায় এই সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সারা বিশ্বকে। চট্টগ্রামেও মহামারির প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে না কীভাবে তারা আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে শনাক্ত হওয়া আক্রান্ত ব্যক্তি ব্যতীত উপসর্গহীন আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বিশেষজ্ঞগণ পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন এবং পরামর্শ দিচ্ছেন মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস পরিবর্তনের।

চট্টগ্রামে গত রোববার নতুন শনাক্ত ৪৯ জনসহ বর্তমান করোনা রোগীর সংখ্যা ২৬৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা, রাজবাড়ী, কুমিল্লা ও কক্সবাজারে শনাক্ত ৭ জনও রয়েছেন। তারমধ্যে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ছাড়পত্র পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন মোট ৬৭ জন। বর্তমানে ২০৬ জন রোগী আইসোলেশনে আছেন, হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ২২৭ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯ জন।

বেশ কয়েকজন আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা কিভাবে আক্রান্ত হয়েছেন তা তারা জানেন না। অনেকে আবার দাবি করছেন, তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে বাহিরে গেলেও সামাজিক দূরত্ব মেনে এবং মুখে মাস্ক পড়েছিলেন। গতকালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুনভাবে শনাক্ত ৪৯ জনের মধ্যে একজন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ছোট ভাই। তার বয়স ৩২ এবং তিনি বর্তমানে নগরীর নাসিরাবাদ এলাকার মেয়র গলির নিজ বাসস্থানে অবস্থান করছেন।

তিনি কিভাবে আক্রান্ত হলেন জানতে চাইলে তার মা হাসিনা মহিউদ্দিন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন আগে ঢাকায় তার সন্তান হয়। তাই সে ঢাকা ছিলো। ঢাকা থেকে গত ৩০ এপ্রিল  চট্টগ্রামে আসে। ঢাকা-চট্টগ্রামের এ যাতায়াত ছাড়া সে বাড়ির বাইরে যেতো না। কিন্তু গত কিছুদিন আগে বাসার নিচে কিছু কাঠের কাজ করা হয়। সে তদারকির জন্য নিচে গিয়েছিলো। এরপর থেকে তার অ্যাজমার সমস্যা দেখা দেয়। অবশ্য তার আগে থেকেই ডাস্ট এলার্জি সমস্যা আছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তার এই সমস্যার কথা শুনে আমাদের জামাতা তার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করায়। গতকাল রিপোর্ট পজিটিভ আসে। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা এখন সম্পূর্ণ ভালো। সে এখন আমাদের বাসার তিনতলায় সম্পূর্ণ আলাদা একটি রুমে নিজেকে আইসোলেট করে রেখেছে। তবে রিপোর্টটা নিয়ে আমাদের সংশয় থাকায় আমরা আবার তার নমুনা পাঠানোর কথা ভাবছি।’

এ ঘটনাসহ আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলা জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটির আহবায়ক ডা. মাহফুজুর রহমানের কাছে সামাজিক সংক্রমণ ও তা মোকাবেলা করার কৌশল জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের পুরনো যা যা অভ্যাস আছে, তা বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাঙালিদের আলাদাভাবে দোষ দেয়াটা ঠিক নয়। সারা বিশ্বের সকল মানুষই একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। ফলে সবাই সবার কাছাকাছি চলে যায়, মুখোমুখি দাঁড়ায় এবং কথা বলে। তাই এ করোনা সংক্রমণের সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের পুরনো অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। ’

অনেকে মুখে মাস্ক পরছে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে বাইরে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন। এই নিয়ম মেনে চলার পরেও কিভাবে সংক্রমিত হচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাস্ক পরলে কারো যদি হাঁচি বা কাশি হয় তার বড় ড্রপলেটগুলো সেখানে আটকে যায়। কিন্তু ১২০ ন্যানোমিটারের ভাইরাস আটকানো কাপড়ের বা সার্জিক্যাল মাস্কের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টি নিয়ে সংশয় আছে। কারণ আমরা কথা বলতে বলতে একটা মানুষের খুব নিকটে চলে যাই। এটি এ সময়ের জন্য আমাদের স্বভাবজাত সমস্যা। তাই রাস্তায় চলাচলে সামাজিক দূরত্ব মানলেও কথা বলার সময় আমাদের আরো সাবধান হতে হবে।’

কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করলে করোনাভাইরাস এ সংক্রমিত হওয়া থেকে বাঁচা যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুখে মাস্ক পরলেও সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ তিন ফুট দূরে থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। এরপরেও কথা বলার সময় মুখোমুখি হয়ে কথা বলা যাবে না। অর্থাৎ কেউ যখন কারো সাথে কথা বলবে তার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলতে হবে। এরপর বাইরে থেকে বাসায় ফিরে তার কাপড়-চোপড় আনটাচড (স্পর্শ হয় না এমন) কোন একটি জায়গায় রাখতে হবে। ২৪ ঘণ্টা আনটাচ অবস্থায় কাপড়-চোপড়ের এ ভাইরাস লেগে থাকলেও সেটি সেখানে মারা যাবে। আর সর্দি, কাশি, হাঁচি ও জ্বর এ ধরনের কোন সমস্যা থাকলে নিজেকে ঘরের মধ্যে আলাদা করে রাখতে হবে। বেশি খারাপ অবস্থা মনে হলে হাসপাতালে সাবধানতার সাথে যেতে হবে।’

বর্তমানে পোশাক ও শিল্প কারখানাসহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাধারণ ছুটি শেষ করে কাজে ফিরেছেন। ফলে সামাজিক সংক্রমণের সম্ভাবনা আরো বাড়ছে। এই সংক্রমণ মোকাবেলায় কী করা যায় তা জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ফয়সল চৌধুরীর কাছে। তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতা ও সাবধানতার বিকল্প কিছু নেই। এরপরেও আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা প্রয়োজন। আর শনাক্ত করার জন্য টেস্টের পরিমাণ বাড়াতে হবে। চট্টগ্রামে প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। চট্টগ্রামে অনেক ডায়াগনস্টিক ল্যাবে আরটি-পিসিআর মেশিন আছে। কিন্তু পরীক্ষার জন্য বায়োসেফটি রুমের প্রয়োজন। চট্টগ্রামের হালিশহরের শেভরনে বায়োসেফটি রুম আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে শেভরনের মালিকদের সাথে কথা বলেছি। সরকার যদি তাদের পরীক্ষার অনুমোদন দেয় এবং কিট সরবরাহ করে তাহলে শেভরনে পরীক্ষা করা সম্ভব। এতে করে পরীক্ষার কোয়ান্টিটি আরো বাড়বে।’

পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তের পরিমাণ বাড়লে আক্রান্তদের আইসোলেট করার প্রয়োজন সৃষ্টি হবে। হাসপাতালে বেড সংকট এড়াতে কিী করা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে হাসপাতালে সংকট হত না। কিন্তু সরকারিভাবে বেশ কিছু হুজুগে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যদি সরকারিভাবে প্রথম অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর যেকোনো একটি হাসপাতালকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ে নিতো, তাহলে হাসপাতালে সংকট হতো না। সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রামে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোকে ব্যবহার করা যায়। এই সিদ্ধান্ত নিলে নতুনভাবে যেসব হাসপাতালগুলো তৈরি করছে, তাতে যে খরচ হচ্ছে এবং হবে তার তুলনায় অনেক কম খরচে আরো বেশি শয্যার হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা সম্ভব হবে।’