একজন মেয়র মকুস ও নাগরিকের ‘সুজন’ পাওয়ার প্রত্যাশায়

সফিক চৌধুরী »

নিজে স্কুটি চালিয়ে স্বচ্ছক্ষে নগরের সমস্যা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়ার মানসে বিগত আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ হতে ‘নগরসেবায় ক্যারাভান কর্মসূচি’ নামে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কে পালিত হয় প্রশাসকের এই কর্মসূচি। তাতে এক্সেস সড়ক ব্যবহারকারী অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেন, যাক অবশেষে হয়তো নতুন এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কের প্রায় পুরো দু’পাশের ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ কাঁচাবাজার আর নানা স্থাপনার জঞ্জাল সরবে, ফুটপাত হবে নাগরিকের জন্য অবারিত! কিন্তু, নাগরিকের এই ভাবনাকে দুর্ভাবনায় রেখে ক্যারাভান কর্মসূচির পরে এখনও নিশ্চিন্তে রয়ে গেছে সবকিছু, তাতে প্রশাসকের এই কর্মসূচি আদৌ কতটা কার্যকর তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়।
কিছু এলাকার সামান্য অংশ বাদ দিয়ে পুরো শহরের বেশির ভাগ ফুটপাতের অবস্থা মোটামুটি একই রকম। অন্য সড়কের কথা না হয় বাদই দিলাম, নতুনভাবে প্রস্তুতকৃত আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কের প্রায় পুরো দেড় কিলোমিটার সড়কের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ফুটপাতে কোথাও কোথাও রাস্তায় পর্যন্ত কাঁচাবাজার, নিত্যব্যবহার্য জিনিস থেকে শুরু করে শখের আসবাব, ব্যক্তিগত গাড়ি মেরামতসহ এমন সবকিছুই চলে নির্বিঘেœ!
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রশাসক সুজনও তাঁর প্রশাসনিক পরিচয় ছাপিয়ে নাগরিকের ‘সুজন’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, আমরা তাঁর যেকোন ভালো ও জনমুখি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই। প্রশাসকের ‘নগরসেবায় ক্যারাভান কর্মসূচি’তে অনেকেই বাহবা দিলেও আমার মনে হয়, এরকম নানা উদ্যোগে সাময়িক কিছু সুফল হয়তো মেলে। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে যদি সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে দিনশেষে সমন্বিত ও টেকসই উন্নয়ন হবে সুদূর-পরাহত। আশা করি, বর্ষীয়ান ও পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ খোরশেদ আলম সুজন প্রশাসক হিসেবে তা উপলব্ধি করবেন এবং সিটি করপোরেশনকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে নাগরিকের কাছে জনবান্ধব করে তুলতে সচেষ্ট হবেন।
যাই হউক, এ প্রসঙ্গে কলম্বিয়ার রাজধানী বগোতার সাবেক মেয়র আন্তানাস মকুসের কথা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পেশায় দার্শনিক ও জাত শিক্ষক মকুস শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়ে বগোতার মানুষের নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। নাগরিক হিসেবে তাঁদের অধিকার ও দায়িত্ব কী, সেসব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন মেয়র মকুস। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রত্যেকে যদি প্রত্যেকের দায়িত্বটুকু পালন করেন, তাহলে দিনশেষে সকলেই লাভবান হবেন। যদিও তিনি জানতেন, কথাটা শুনতে অনেক সহজ-সরল মনে হলেও আমরা তা করতে রাজি নই, কারণ নিজের স্বার্থের বাইরে অন্যের কথা ভাবার বা সেই মতো কাজ করার মানসিকতা-অভ্যাস আমাদের অনেকেরই নেই।
মকুস দীর্ঘদিনের সেই অভ্যাসটা বদলিয়ে নাগরিকের সম্মিলিত অংশগ্রহণের এক নাগরিক সংস্কৃতি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এই কাজটা করতে তিনি মাইম, ক্লাউন ও থিয়েটারের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করেছেন এবং সফলতাও পেয়েছিলেন।
আমরা যদি বাসযোগ্য ও সুন্দর নগরী চাই, তাহলে অবশ্যই নগরের উন্নয়নে নগরের আইনকানুন, মানুষের নীতিÑনৈতিকতা ও সমাজ-সংস্কৃতিকে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখা জরুরি, সব নাগরিকের লক্ষ্য আইন ভাঙা বা সরকারকে ফাঁকি দেওয়া নয়। আর গুটিকয়েক যারা আইন মানতে অভ্যস্ত নয়, তাঁকে যদি বোঝানো যায়, আইন মানা না হলে আদতে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাহলে সে বা তারা নিজেদের বদলাবেই। তবে, কোন নগরকে যদি সচল ও বাসযোগ্য করতে হয়, তাহলে সবার আগে প্রয়োজন নগরের সেবা সংস্থাগুলোকে নিজ দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান হওয়া এবং সেই সাথে নাগরিকদেরও তাঁদের নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে সচেতন করে তোলা। আর তার জন্য দরকার নাগরিকের নাগরিক শিক্ষা বা সিভিক এডুকেশন।
পরিকল্পিত নগরীর কথা আমরা বলি, কিন্তু সেইমতো পরিকল্পনা কী আমরা করি? চট্টগ্রামে এখন অনেকগুলো উড়ালসড়ক, যদিও সেগুলো প্রায়শই থাকে ফাঁকা! আমরা কী একবারও ভেবে দেখেছি, কেন উড়াল সড়কের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না? আমরা কী তা নিয়ে ভেবেছি? আমাদের অনেকগুলো রাস্তাকেই যানজট এড়াতে মোড়গুলো বন্ধ করে একমুখী করা হয়েছে, কিন্তু পথচলতি মানুষের রাস্তা পারাপারে কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি! তাতে পথচলতি মানুষজন বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে এলোপাতাড়ি রাস্তা পার হতে গিয়ে যানজটের সৃষ্টি করছে। কিন্তু, এভাবে আর কতদিন? বাণিজ্যিক রাজধানীকে সামগ্রিক উনয়নের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, স্বল্প সময়ের দায়িত্ব হলেও একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সমন্বয় ঘটিয়ে প্রশাসক পরিচয় ছাপিয়ে সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নাগরিকের ‘সুজন’ হয়ে উঠতে সচেষ্ট হবেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক
নড়ষড়ংযধভরয়ঁব@মসধরষ.পড়স