আহ এমন মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?

জন্মনিবন্ধনে বয়স ভুল, ঠিক করতে তিনদিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের দৌড়াদৌড়ি

অবশেষে গলায়  ফাঁস লাগিয়ে স্কুল ছাত্রের আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিনিধি, আনোয়ারা:

বিদ্যালয়ে জেএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের কার্যক্রম চললেও করোনা পরিসি’তির কারণে বিষয়টা জানতো না স্কুল ছাত্র। জেনেছে অনেক পরে। যখন জেনেছে তখন তার হাতে সময় ছিল মাত্র ৪ দিন। কিন’ রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে জানতে পারে জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী তার বয়স তিন বছর বেশি। ফলে তার হবে না রেজিস্ট্রেশন। এটা শোনার পর সে বিভিন্ন দপ্তরে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। প্রথমে চাতরী ইউনিয়নের তথ্য সেবাকেন্দ্রে গেলে সেখান থেকে তাকে বলা হয় স্কুল থেকে একটা প্রত্যয়নপত্র নিয়ে আসতে। দ্রুত টাকা নিয়ে প্রত্যয়নপত্রের জন্য ছুঁটে যায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিড়্গকের কাছে। প্রধান শিড়্গক ২০০ টাকার বিনিময়ে তাকে প্রত্যয়নপত্র দিলেও সেখানেও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দেওয়া ১৮ ডিসেম্বর ২০০৩ সাল উলেস্নখ থাকা। প্রত্যয়নপত্রটি নিয়ে সে ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্রে গেলে তারা সাফ জানিয়ে দেয় এটি নতুন করে সংশোধন হবে না। এভাবে টানা তিনদিন ধরে তিন অফিসে ঘুরেও জন্ম তারিখ সংশোধন করতে না পেরে অবশেষে আত্মহত্যা করলেন কৈনপুরা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী দুর্জয় দাশ। গত সোমবার (২৯ জুন) রাতে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার চাতরী ইউনিয়নের কৈনপুরা জলদাশপাড়ায় ঘটে।

সে স্থানীয় জলদাশপাড়ার মিলন দাশের ছেলে। তার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার (ভারপ্রাপ্ত) সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তাদের ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র থেকে জন্মনিবন্ধন সংশোধন করে আনতে বলেন। এদিকে স্কুল থেকে জানানো হয় ৩০ জুনের পর রেজিস্ট্রেশন আর হবে না। দুর্জয় দাশ এই অফিস থেকে ওই অফিসে  ঘোরাঘুরি করে জন্মনিবন্ধন সংশোধন এবং জেএসসির রেজিষ্ট্রেশন করতে না পেরে ড়্গোভে আর অভিমানে অবশেষে আত্মহত্যা করে। দুর্জয়ের ছোট বোন পুষ্প দাশ বলেন, বিকেলে আমি ভাইয়াকে খুঁজতে গিয়ে ঘরের সঙ্গে রশিতে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখি। সঙ্গে সঙ্গে আমি দা দিয়ে রশি কেটে ভাইয়াকে কাটে শোয়ায়।

দুর্জয় দাশের পিতা মিলন দাশ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, গরিব হলেও বড় আশা ছিল ছেলেকে লেখাপড়া করানোর। আমরা অশিড়্গিত মানুষ জন্মনিবন্ধন সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। বড় ছেলেটাকে অভাবের কারণে বেশি লেখাপড়া করাতে না পেরে গার্মেন্টসে চাকরি দিয়েছি। আমার ছেলের বয়স ১৩ বছরের বেশি নয়। কাগজে কি লিখল জানি না। স্কুল থেকে বলেছে বয়স বেশি তাই ঠিক করতে না পারলে রেজিস্ট্রেশন হবে না। আমার ছেলেটা স্কুলসহ বিভিন্ন অফিসে গিয়েও সোমবার বিকালে আমাকে জানাল সংশোধন করতে পারেনি এবং স্কুল থেকে বলেছে জেএসসি পরীক্ষাও দিতে পারবে না। কিছুড়্গণ পর শুনলাম ছেলে আত্মহত্যা করেছে। আদরের সনত্মান দুর্জয় দাশকে হারিয়ে আমরা পাগল প্রায়। এটা আত্মহত্যা না তাকে আত্মহত্যা করার বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ স্বজনদের। সে এতো হয়রানি থেকে বাঁচতে কোনো উপার না পেয়ে সে এ পথ বেছে নিয়েছে। আমরা এটার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

দূরসর্ম্পকের মামা বরুণ দাশ বলেন, সে যখন আমাকে বিষয়টা জানিয়েছে আমি তাকে নিয়ে স্কুলের প্রধান শিড়্গকের কাছে যায়। তখন তিনি বলেন সে জন্মনিবন্ধন ঠিক করে আসনে পারলে পরীক্ষা দিতে পারবে, না হলে আগামী বছর দিবে আরকি। আমি কি করতাম তো। তখন তাকে নিয়ে আমি উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে গিয়েছি। শেষমেশ উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে গেলে তিনি আমাকে চাতরী ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে যেতে বলেন। চেয়ারম্যান তখন জন্মনিবন্ধনটি ঠিক করে দেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাকে বলেন। তখনি আমরা ছুঁটে যায় উনার কাছে। কিন’ তখন তিনি সার্ভার নস্ট এখন করা যাবে না। প্রত্যায়ন পত্র নিয়ে আসেন বলে সাফ জানিয়ে দেয়। তখনি আমরা আর কোনো উপায় না পেয়ে বাড়িতে চলে আসি এবং তাকে বলি কোন চিনত্মা করিস না প্রয়োজনে আমরা বোর্ডে যান।

চাতরী ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে তার কাগজপত্র দেখে জন্মনিবন্ধনটি ঠিক করে দিতে বলেন। এখন দেখি যেটা আছে সেটা নাকি হবে না। আমি তাকে স্কুল থেকে জন্ম তারিখটা লিখে একটি প্রত্যায়নপত্র নিয়ে আসলে জন্মনিবন্ধন সংশোধন করা যাবে বলছিলাম।

কৈনপুরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিড়্গক সুধাংশু চন্দ্র দেবনাথ বলেন, বয়সের ব্যাপারে শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালা আছে। ওই শিক্ষার্থীর বয়স জন্মনিবন্ধন ও পিএসসি সনদে বেশি হওয়ায় তাকে তা সংশোধন করে আনতে বলেছি। বেশি বয়সে কেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করালেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তখন আমরা এটা খেয়াল করিনি।

আনোয়ারা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম বলেন, স্কুল শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনাটি আমি শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এখানে যদি আমাদের কোন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ দুলাল মাহমুদ বলেন, কৈনপুরা এলাকায় স্কুলছাত্র আত্মহত্যার বিষয়টি শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে থানা কোনো অভিযোগ হয়নি।