আঞ্চলিক ভাষার শক্তি ও পারিপার্শ্বিকতা

হাফিজ রশিদ খান :

মাতৃ বা স্থানীয় ভাষার সম্ভাবনাময় উদ্ভাসন নিয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন করে ভাবনাচিন্তার পরিসর তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি এখন আর ‘অশিক্ষিতের’ কাঁচা আবেগ প্রকাশ বা পিছিয়ে থাকা ‘খেতের’ মতো কোনো প্রপঞ্চকে ধারণ করে না। অর্থাৎ স্থানীয় ভাষা বা পৃথিবীর স্থানিক মানুষের মুখের বুলিকে সংবর্ধনা জানাতে এখন বিশ্বের সংবেদন প্রস্তুত হয়ে আছে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায়। স্মরণ করা যাক, উনিশ শ চুয়াত্তর সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের উনত্রিশতম সাধারণ অধিবেশনে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত দাপুটে ভাষাগুলোর তুলনায় একেবারেই একটি আঞ্চলিক বা প্রান্তিক ভাষায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের যুগান্তকারী ঘটনাটি। বিশ শতক পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণের মাধ্যমে ভাষাকেন্দ্রিক ওই নতুন বলয়টি এখন আরও অনেক গতিময়তা ও সাবলীলতা অর্জন করেছে। ভাবনাটির আরও গভীর কেন্দ্রে রয়েছে বিগত বিশ শতকের উনিশ শ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির বাংলা ভাষকেন্দ্রিক জাগরণ। ওই সময়ে চাপিয়ে দেয়া ঔপনিবেশিক উর্দু ভাষার বিপরীতে বাংলা মাতৃজবানের মর্যাদারক্ষায় ঢাকার বুকে পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন এদেশের জাগ্রত তরুণদের কয়েকজন। এভাবে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক উত্থানটি ক্রমে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। তারই জের ধরে এদেশের ইতিহাসে যুক্ত হয় স্বাধিকারের স্বপ্নডানা। যার ক্রমান্বয়িক অভিপ্রকাশ জাতিকে নিয়ে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দুর্মর রণক্ষেত্রে। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনের বন্ধন ছিঁড়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। যে-রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষার মর্যাদায় আসীন এখন সেই বাংলা ভাষাই।

এরই পাশাপাশি আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। তাহলো : ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার (ইউনেসকো) সাধারণ পরিষদে দুই বাঙালি সন্তান রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের প্রচেষ্টায় ভাষাবিষয়ে গৃহীত হয় আরও একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব। যেটির মর্মার্থ হলো, রক্তস্নাত মহান একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে পরবর্তী ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে বিশ্বব্যাপী পালন করা। বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা রক্ষার দিবসটির এই বিশ্বাবয়ব প্রাপ্তিতে দুটো ঘটনা ঘটেছে সমান্তরালে। একটি হলো, ভাষাকেন্দ্রিক আত্মদানের বাঙালির ওই কৃতিত্বপূর্ণ ঘটনাটি আর সীমাবদ্ধ রইল না নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসীমায়। বলা যায়, বাঙালির পুঞ্জীভূত আবেগ-আকাক্সক্ষা এ অভিপ্রায়ের মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল ভোরের কুসুমের নিরন্তর মৃদু-মদির সুবাসের মতো। জাতীয় অহং ও একধরনের আত্মগৌরববোধে মহিমান্বিত হলো বাঙালির হৃদয়ে বহু যুগলালিত ঐতিহাসিক দিনটি। দ্বিতীয়ত, একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিকীকরণ বিশ্বের বিপন্ন জাতিসত্তা ও তাদের অবহেলিত ভাষাসমূহ রক্ষার লড়াইয়ে নতুনমাত্রা যোগ করতে সমর্থ হলো। সেই সঙ্গে জাতীয়তাবোধ বা জাতীয়তাবাদী মনস্তত্ত্বেরও প্রসার ঘটিয়েছে খুব গভীর-গোপনতলে। ভাষাচেতনা যে জাতীয় মুক্তির অবিনাশী বীজধারণ করে থাকে তার অতলগর্ভে, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তো বাঙালি ও বাংলাভাষাকেন্দ্রিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। বিশ্বায়নের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনার ওই বিস্তৃতিতে উল্লিখিত দ্বিতীয় পরিসরটি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে সবিশেষ মনোযোগ আকর্ষণের দাবিদার। কারণ এটি মাতৃভাষা, অতঃপর মাতৃভূমিকেন্দ্রিক স্বাজাত্যবোধের উন্মোচক, প্ররোচকও বটে। যা আমরা ইতোপূর্বে কিছুটা উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশে এর ঢেউ কিঞ্চিৎ টের পাওয়া যাচ্ছে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ও অন্যান্য দেশের ভেতরে বসবাসরত স্বাতন্ত্রিক ও নিম্নবর্গীয় জাতিসত্তাগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আওয়াজের মধ্যে। বিষয়টি ওখানেই শুধু থেমে নেই। এর বিস্তার ঘটছে নানা চেহারায়, নানামাত্রায়, নানাদিকে, নানা অভিপ্রায়ে।

তারই একটি হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রাণশক্তি ও তার বিচিত্র মানবিক অভিব্যক্তি প্রকাশের সক্ষমতা নিয়ে এখানকার ও এখনকার সুধীসমাজে নতুন ভাবনার সঞ্চালন পরিলক্ষিত হওয়া। এই অঞ্চলের মাটির সন্তান ও শুদ্ধাত্মাগণ, যেমন : আসকর আলী প-িত, রমেশ শীল, খায়রুজ্জামান প-িত, সেকান্দর প-িত, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মোহাম্মদ নাসির, চিরঞ্জীব দাশ শর্মা, এবনে গোলাম নবী, মোহনলাল দাশ, অজিতবরণ শর্মা, অমলেন্দু বিশ্বাস, মুন্সী বজলুর রহমান, ফণী বড়–য়া, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার, শ্যাসুন্দর বৈষ্ণব, ইয়াকুব আলী, লক্ষ্মীপদ আচার্য্য, কাজল দাশ, শাহাদাত আলী, এম এ রশিদ, বাবুল আচার্য্য,  এম এ তাহের, আহম্মদ কবির আজাদ, সৈয়দ মহিউদ্দিন, সনজিৎ আচার্য্য, দীপক আচার্য্য, নুরুল আলম, স্বপন কুমার দাশ, সিরাজুল ইসলাম আজাদ প্রমুখ গীতিকবি ও গায়কের কলমে ও সুরধারায় এ ভাষাটি রূপ পেয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকজীবনধারার সুখদুঃখ, হাসিকান্না, সংগ্রামী ঐতিহ্য, পির-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসীর ধ্যান, প্রবাসে আকর্ষণ ও বিপর্যয়, নদী ও সাম্পানকেন্দ্রিক জীবিকা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও তার বিপন্নতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নরনারীর সম্পর্ক, স্বস্থানপ্রীতি, প্রেম-বিরহের রাগ-বিরাগ, বিয়ের হঁওলা, হাস্যরস, রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপুল ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস।

প্রাণের আদরমাখা ও অকৃত্রিম অনুভূতিসঞ্জাত ব্যঞ্জনাম-িত চট্টগ্রামের লোকায়ত শব্দসমূহের সমবায়ে তাঁরা এই জনপদের উন্মুক্ত সাংগীতিক মহাকাব্য বা গাথারচনা করেছেন। সেই ধারা থেমে নেই, চলছে আজও অবিরাম ধারায়, নতুন-নতুন রসম-িত হয়ে। অন্তরের আর্তি প্রকাশ আর জীবনের পরতে-পরতে পরিপূর্ণ ও সার্বিক জীবনাকাক্সক্ষা অভিযোজনের মাধ্যমরূপে তাঁরা গ্রহণ করেছেন এই লোকভাষাকেই, যা লোকমানসের তলহীন, বিশাল ভাবনারাশির প্রকৃত তর্জমাকারক ও উপস্থাপক। এই ভাষাকে তারা মাতৃভাষারূপে সংস্থিত জেনেই অর্ঘ্য দিয়েছেন অন্তর্গত ভাববিপ্লব, কল্পনাপ্রতিভা, যাপমান ও যাপিত জীবনের সকল রকমের বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা।

এ থেকে পাওয়া যায় জাতীয় ভাষার পরিকাঠামোর খুব নিকটেই সতত সঞ্চরণশীল হৃদয়সংবেদী লোক বা আঞ্চলিক ভাষার শক্তপোক্ত অবস্থানের ভিত্তিটিও। যার চির বিদ্যমানতার ভেতর লুকিয়ে আছে মৃত্তিকার পরশভরা মাতৃত্বের মায়া, পরিপার্শ্বের প্রতি দৃক নিক্ষেপে ‘সহজ’ মানুষের ভাবুকতা ও আধ্যাত্মিক অনুরণনের কথকতা।

আরও সঠিকভাবে ও খোলসাভাবে বলা যায়, এসব ইতিবাচকতা ও বৈচিত্র্য নিয়ে আঞ্চলিক ভাষা বা ভাষাসমূহ বাঙালি জাতিসত্তার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভেতর বিরাজমান ভাষাসৌন্দর্যের আকরবিশেষ। একই নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের জাতিসত্তার বসবাসের ভূখ-ে নানা আঞ্চলিক বা লোকভাষার অস্তিত্ব থাকাটা ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আশ্চর্যজনক বা আপতিক কিছু নয়। বরং খুব স্বাভাবিক ও সহজাত। সেই জন্যেই তা জীবনের অপরিহার্য অংশ। তবে ওই ভাষা ও ভাষাভাষী জনমানুষের অন্তরাত্মায় যে-জাগতিক ও পারিপার্শ্বিক চাওয়া-পাওয়ার নিত্যস্পন্দন শুনতে পাওয়া যায়, তা যেন শতফুলের বাগিচার মতো সমতালে বিকশিত, সমাদৃত ও সদা প্রফুল্লতা লাভ করতে পারে। আর ওই বাতাবরণ তৈরিতে সমাজ ও রাষ্ট্রচালকদের বিচক্ষণতাই হতে হবে প্রধান সমিধ। রাষ্টযন্ত্র যদি এক্ষেত্রে আলগা নজরের ‘অপর’ দৃষ্টান্ত প্রসারিত করে আভিজাত্যের অজুহাতে কিংবা প্রমিতভাষার দোহাই পাড়ে, তাহলেই হামলে পড়ার বিপুল মওকা তুলে দেয়া হবে বিশ্বায়নের আগ্রাসী পণ্যসংস্কৃতির সিন্ডিকেটকে। যার অনিবার্য দর্শন হলো বিভাজন তৈরি করা আর সেই বিভাজনের ভেতর তাদের পণ্যসংস্কৃতির নগ্নতাকে সম্প্রসারিত করা। অবহেলিত, বিপন্ন আঞ্চলিক ভাষাগুলোর প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার নামে তাদের মেলায়, পার্বণে অনুপ্রবেশ আর বাণিজ্য উদযাপন করার সদানন্দ সুযোগ নেবে ওই পণ্যহায়েনারা। এভাবে বঞ্চিত আঞ্চলিক মানুষেরা তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির আহ্লাদে বৃহত্তর চেতনা জলাঞ্জলি দিতে উদ্যত হলে বিশ্বায়ন-ডিসকোর্সের  আকর্ণবিস্তৃত বিজয়ী হাসি গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে প্রকৃত স্বভাষা ও স্বদেশপ্রেমিক আমলাতন্ত্রেও। কেননা ওই পণ্যবাঘেরা তখন দেশজসংস্কৃতির বৈচিত্র্য, প্রকারান্তরে ভৌগোলিক অখ-তা বা একরূপতায় বিনষ্টির ঘুণ প্রসারিত করতে পারে নানা অছিলা ও কৌশলকলায়।

কাজেই, এই উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ের রাষ্ট্রচালকদের জন্যে দেশজ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার সাথে-সাথে ভাষা ও সংস্কৃতির আঞ্চলিক স্বতন্ত্রতা রক্ষায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞাময় অগ্রগামী মননের অধিকারী হওয়াটা অতীব জরুরি বিষয় এখন। ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো কূপম-ুক কর্তৃত্ববাদিতায় যার সমাধান সম্ভব নয়, বরং ‘যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে, মুক্ত কর হে বন্ধ’Ñ এ নীতিতেই খুঁজতে হবে উত্তরণপ্রয়াসী আলোর পথ।