আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : তাঁরা জাতিগঠনে প্রেরণার শিখা

আজ জাতির জন্যে ভারি শোকাবহ দিন। আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। তাঁরা ছিলেন সেই দীপশিখা, শত দুর্বিপাকেও নেভে না যা কখনো। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যেসব অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, দার্শনিক তথা দেশের সেরা সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তাঁরা তাঁদের নিকষিত চৈতন্যের কাছে আপোষ করেননি আমৃত্যু। দেশ, জাতি ও মানুষের প্রতি যে-দায়বদ্ধতা তাঁদের হৃদয়কে শান্ত ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রেখেছিল, সেখানে তাঁরা স্বচ্ছ ও সুন্দর ছিলেন বলেই হায়েনার ক্রোধ তাঁদের ওপর নিপতিত হয়েছিল। চারিত্রিক দৃঢ়তার ওই বারুদই পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস নামক নেউটেদের চোয়ালে জ্বালিয়ে দিয়েছিল হিংস্রতার ধিকি ধিকি আগুন। সেই অন্তর্জ¡ালা তারা প্রশমন করেছিল বর্বরতার উল্লাসে। বুদ্ধিজীবীদের হাত পিছমোড়া করে বেঁেধ হত্যার মধ্য দিয়ে।
পৃথিবীর ইতিহাস অতীতে এমন নৃশংসতা দেখেছিল আরেকবার। জার্মানির হিটলার ও তার নাজিবাহিনীর নির্মমতার মধ্যে। ১৯৭১ সালে তারই মহড়া হলো যেন বাংলার মাটিতে। যখন বিজয়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল একেবারে দোরগোড়ায়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো হায়েনাদের নতমুখ পরাজয় বরণের মাধ্যমে। আর আমরা বিজয়ের আনন্দকে ম্লানমুখে স্বাগত জানালাম। বুকে যে তখন ভাই হারানো, বোন হারানো, স্বজন-প্রিয়জন হারানো দগদগে বেদনার দাগ। বাঙালির দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে দেশের কবিÑসাহিত্যিক শিক্ষকÑসাংবাদিক, সঙ্গীত শিল্পী, চিকিৎসক, শিল্পী তথা সচেতন পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন সংগঠিত করার পাশাপাশি লেখা, বক্তৃতা, গানÑকবিতাÑনাটকÑ চলচ্চিত্র ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতা ও মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নিপীড়নÑনির্যাতন ও সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে মহাজাগরণ শুরু হয়েছিলো, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা সেই আন্দোলনে ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক সহযোদ্ধা। পাকিস্তানি সামরিক শাসক ও তাদের রাজনৈতিক দোসররা তাই মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন এইসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যার টার্গেট করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য এখানে যে, এ আত্মদান আমাদের মেরুদ- শক্ত ও সবল রাখার শিক্ষা দিয়ে যায়। কোনো অবস্থাতেই অন্যায় ও অবিচারের কাছে মাথা নত না-করার এ শিক্ষা জাতির কাছে তাঁরা সুস্পষ্ট অঙ্গীকারের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন মৃত্যু-মুহূর্তের সেই অব্যক্ত ভাষায়। তাঁরা চাইলে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ ঘেরে আশ্রয় নিতে পারতেন। পারতেন গা ঢাকা দিয়ে জীবনযাপন করতে দূরের লোকালয়ে। কিন্তু তাঁরা তো জানতেন, শিক্ষালয়ে ও সমাজে তাঁরা সৎ মনোবলে বলীয়ান হয়ে জ্ঞানের বিতরক ও সেবাব্রতী। সত্য ও ন্যায়ের পাহারাদার। এই স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছার ভিত্তি কাল হয়ে আখেরে তাঁদের জীবন কেড়ে নিলেও জয় হয়েছে তাঁদের অন্তরাত্মরই। তাঁদের জ্ঞানের শক্তিরই বিজয় হয়েছে। বরণযোগ্য হয়েছে তাঁদের নিবিড় তপস্যা। তাঁরা জাতিগঠনে প্রেরণার শিখা হয়েছেন অনির্বাণ উজ্জ্বলতায়। জাতীয় চৈতন্যের বৈকুণ্ঠে এখন নিত্য তাঁদের উজ্জ্বল স্বরধ্বনি শোনা যায়।
শিক্ষায়, চিকিৎসায়, সাংবাদিকতা তথা মানবিকতার সকল দিগন্ত স্বদেশের পরিধি ছাড়িয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান রয়েছে প্রচ্ছন্নে। একাত্তরে যা ভেতর থেকে জাগিয়েছিল বাঙালির জাতীয়সত্তাকে। বাঙালির প্রতœচেতনাকে। নতুন প্রজন্মের স্নায়ুতে বয়ে যাচ্ছে যেন তাঁদের সেই বিদ্যুৎগর্ভ চিন্তা ও চেতনার ধারা। জীবনের সকল দিকে দেশের শ্রেষ্ঠত্বকে উন্মোচন করে তা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ব্রতে বাঙালি সন্তানেরা ব্যাপকভাবে সচল ও কর্মিষ্ঠ এখন। বিশ্বের দেশে-দেশে বাঙালি সন্তানের কর্মস্পৃহা ও তা থেকে উচ্ছৃত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেশের কল্যাণে নিয়োজিত হচ্ছে। মানুষের ভেতরে আশা ও আকাক্সক্ষার আলো জ্বলে উঠছে দিন দিন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ে জড়িত পাকিস্তানি হানাদারদের এদেশীয় দোসরদের জনাকয়েকের বিচার ও দ- কার্যকর হয়েছে। তবে পাশাপাশি বিদেশে পালিয়ে বেড়ানো ঘাতকদের ফিরিয়ে এনে তাদের বিচার জাতির প্রত্যাশিত হলেও তাতে ফলপ্রসূ অগ্রগতি না থাকায় আমাদের চিত্তে অসন্তোষের মেঘ জমে থাকে সর্বক্ষণ। অবিলম্বে এই কুলঙ্গারদের বিচার এদেশের মাটিতে সম্পন্ন করতে হবে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।