আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু প্রকৃত দেশপ্রেমিক

বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ »

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একটি আদর্শের নাম যে আদর্শ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে একজন দেশপ্রেমিক সফল নেতা হতে। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন একজন জনপ্রিয় রাজনীতিক। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যিরি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আমৃত্যু আনোয়ারা কর্ণফুলীর মানুষের পাশে নিজেকে উজাড় করে গেছেন। নীতি নৈতিকতা ছিল তাঁর অনন্য সম্পদ। সাধারণ জনগণ ছিলেন তাঁর পরম আত্মীয়, জয় করেছেন তাদের মন, ভালবাসা। চট্টগ্রামে আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ছিলেন তিনি, ১৯৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তাঁর অবদান অপরিসীম। একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিক ও সমাজসেবকের যে সমস্ত গুণ থাকা উচিত, তার সবই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মধ্যে ছিল।
কেবল রাজনীতিই নয়, ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।
১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী এবং জমিদার। তাঁর মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুর নাহার জামান এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঐ বছরই ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। ওখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন।
তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকা- পরিচালিত হত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।
১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে দলের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারানির্যাতন ভোগ করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দু’দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৮৮ সালে এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে যে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন সংগ্রাম-আন্দোলনে তাঁর স্মৃতি জনগণের মানসপটে আঁকা। আজ তিনি চট্টগ্রাম সহ সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তাঁর স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ।

লেখক : আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর
সাবেক একান্ত সচিব